বিক্ষিপ্ত মন………

মনটা খুব বিক্ষিপ্ত। গত দুই দিনে দুইটা অপারেশন হলো, একটা PLID (কোমরে ব্যথা), আরেকটা ব্রেইন টিউমারের। দুই রোগীই খুব ভালো আছে।আজ সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় এসেছি (সময়ের হিসেবে গতকাল), তাও বিক্ষিপ্ত ভাবটা কাটছে না। রাত নয় টা থেকে ইন্টারনেটে একটার পর একটা সাইটে যাচ্ছি, বিভিন্ন লেখা পড়ছি। কখনো চতুরে, কখনো মুক্তব্লগে, কখনোবা সচলায়তনে। লেখা পড়ছি, মন্তব্য লিখছি। তাও বিক্ষিপ্ত ভাবটা কাটছে না। টিভিতে Ten Cricket-এ পাকিস্তান আর ওয়েষ্ট ইন্ডিজের লাইভ খেলা ছেড়ে দিয়ে, ল্যাপটপে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে একসময় চোখ আটকে গেলো bdnews24.com-এ শফিক রেহমানের রাজকীয় বিয়ে নিয়ে একটি লেখায়।

রাজকীয় বিয়ে নিয়ে লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়, সেটি আমি পুরোপুরি পড়িও নি, কারণ আরেকটা লেখার প্রতি হঠাৎ আগ্রহ হয়ে পড়ায়-‘মেহেরজান’-রুবাইয়াত হোসেনের প্রথম পরিচালিত ছবি নিয়ে একটি বৈঠকের কথোপকথন। ছবিটি আমি দেখিনি, যেমন এখন পর্যন্ত দেখিনি গেরিলা ছবিটাও। গত সপ্তাহে ঢাকায় স্টার সিনেপ্লেক্সে এসে আমি আর আমার স্ত্রী গেরিলার টিকেট কেটেছিলাম মুভিটি দেখবো বলে (কয়েকটা রিভিউ পড়েছি বলে আগ্রহ ছিলো), কিন্তু এক অনিবার্য কারণে শেষ পর্যন্ত দেখা হয়নি।

আমি প্রচন্ড মুভি দেখি। যখন স্কুলে পড়তাম, উত্তম-সুচিত্রা-ই শুধু দেখা হতো। বাবা-মায়ের খুব প্রিয় জুটি ছিলো তাঁরা। শতাব্দী, পথে হলো দেরী, সাগরিকা, হারানো সুর, বিপাশা, চাওয়া-পাওয়া, সাড়ে চুয়াত্তর, জীবন তৃষ্না, নবরাগ, হার মানা হার, ইন্দ্রানী, মরনের পরে, অন্নপূর্ণা মন্দির, ওরা থাকে আঁধারে- কতো ছবিই যে দেখেছি এই জুটির, যা এখনো চোখ বন্ধ করলেই মনের পর্দায় ভেসে উঠে। এছাড়া উত্তমের আরো ছবি অমানুষ, চিড়িয়াখানা, গৃহদাহ, উত্তরায়ন, আনন্দ আশ্রম, এখানে পিঞ্জর, এন্টনী ফিরিঙ্গি- নাম শেষ করা যাবে না। মনে পড়ে-শিল্পী ছবিতে উত্তম কুমারের শেষ পরিনতি দেখে যেমন খুব কেঁদেছি, তেমনি শেষ অংক-তে ভিলেন হিসেবে কখনোই মানতে পারি নি। আবার নায়ক দেখে জীবনে আর কখনো নায়ক হতে ইচ্ছে করিনি –এই আমি আমাকে হারিয়ে ফেলবো এই ভয়ে।

কলেজে উঠে প্রথম হিন্দী ছবি দেখি আমি, সেটা কুছ কুছ হোতা হ্যায়। সেই প্রথম আমার শাহরুখ আর কাজলকে দেখা। মজার ব্যাপার হচ্ছে ছবিটি আমি এই জুটির জন্য দেখিনি, দেখেছি রানী মুখার্জীর জন্য। বন্ধুরা বলাবলি করতো রানী নামে এক খুব ড্যাম স্মার্ট মেয়ে এই ছবিতে অভিনয় করেছে, একেবারে সবার হার্টথ্রর্ব। তাই এক বন্ধের দিনে বন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখা, সেখানেই আরেকদিন দেখলাম রঙ্গিলা।ঊর্মিলাতে আমাকে পেয়ে বসলো, কিন্তু তখনো হিন্দী ছবির পোকা আমার মাথায় ঢুকেনি।মেডিকেলে ভর্তি হবার আগে খুব কমই হিন্দী ছবি দেখেছিলাম, আর সব নায়িকাকেই মনে হতো ঊর্মিলা।(তাই যখন প্রথম শিফাকে দেখেছিলাম, ঊর্মিলার কথাই মনে পড়েছিলো।)

মেডিকেলে যখন ভর্তি হলাম, আমার রুমমেট ফয়েজ সারাদিন হিন্দী গান শুনতো, আর আমি শুনতাম রবীন্দ্র, নজরুল। আমার আরেক রুমমেট যেহেতু নেপালী ছিলো, আমি স্বভাবতই রুমে কোনঠাসা থাকতাম। ঠিক এই রকম মূহুর্তে একরাতে হোস্টেলের কমন রুমের টিভিতে সেই সময়কার সুপার হিট ছবি তাল দেখানো হলো।ঐশ্বরিয়াকে দেখে মনে হলো এত সুন্দর মেয়েও আছে এই পৃথিবীতে! মনোয়ার ছিলো হিন্দী ছবির জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। ওর পাল্লায় পড়ে আস্তে আস্তে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে অনেক হিন্দী ছবি দেখে ফেললাম। হিন্দী কথা বুঝতে পারতাম না, অনুবাদকের কাজটা করতো মনোয়ার। এভাবে দেখা হয়ে গেলো দিলওলেয়ে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে, ইশক, সারফারোশ, জো জিতা ওহি সিকান্দার, গোলাম, মন থেকে শুরু করে ডুপ্লিকেট, পরদেশ, দিলতো পাগল হ্যায়, দিলসে, বাস্তব, খল নায়ক, চলতে চলতে অনেক, অনেক, অনেক……। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মনের মনিকোঠায় সুচিত্রা, সুপ্রিয়ার জায়গায় কখন যে জুহি চাওলা, মাধুরী, কাজল চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি।

এভাবেই মেডিকেলের পাঁচটি বছর পার করে ইন্টার্নীতে ঢুকলাম।

একদিন হঠাৎ আশিক (আমেরিকান-বাংলাদেশী) এসে হাতে একটি ডিভিডি ধরিয়ে দিয়ে দেখতে বললো। তাকিয়ে দেখি ইংরেজী মুভি, নাম Life is beautiful. খুব একটা গুরুত্ব দিলাম না, আমি আগে কখনো ইংরেজী মুভি দেখেনি। তারপরও, একরাতে দুইটা বেজে গেছে, ঘুম আসছিলো না, তখন ল্যপটপে কানে হেডফোন লাগিয়ে মুভিটি দেখেছিলাম। ভোর পাঁচটার দিকে একেবারে শেষে ‘This is my story. This is the sacrifice my father made. This was his gift to me’-শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি, হু হু করে কেঁদে উঠেছিলাম। সকাল বেলায় ক্লাসে গিয়ে মেয়েদেরকে বলেছি-‘Buon giorno, Principessa!’। আশিককে বললাম আরেকটা ডিভিডি দিতে। এবার দিলো সে American Psycho, দেখে আমারই সাইকো হবার মতো দশা।ছবিটি চার বার দেখেও আমি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলাম না। আশিকের দেওয়া পরবর্তী ডিভিডি ছিলো Calligula, ছেলেটা আসলেই জিনিয়াস। তিনদিনে তিন ভিন্ন ধরনের ছবি দিয়ে আমাকে একেবারে ইংরেজী ছবির নেশা ধরিয়ে দিলো, যে নেশা থেকে আমি এখনো মুক্তি পেতে পারিনি।

আমি কি তাহলে বাংলাদেশের কোনো ছবি দেখেনি? হ্যাঁ, তাও দেখেছি। আমার দেখা প্রথম বাংলাদেশের ছবি, যদি স্মরনশক্তি আমার সাথে প্রতারনা না করে, ‘প্রতিরোধ’-যতদূর মনে আছে নায়ক ছিলো আলমগীর, নায়িকা শাবানা বা ববিতা।ছবিটা সিনেমা হলে গিয়ে দেখা, আমরা সবাই নানা বাড়ি গিয়েছিলাম বেড়াতে। বাবা আমার খালাদের আবদার এড়াতে পারেননি।দ্বিতীয় ছবিটাও হলে গিয়ে দেখা, সে সময়কার খুব জনপ্রিয় ছবি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’। অঞ্জু ঘোষ আর ইলিয়াস কাঞ্চনের এই ছবিটা দেখে অনেকদিন ধরেই ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না আমায় কথা দিয়েছে, আসি আসি করে জ্যোৎস্না আমায় ফাঁকি দিয়েছে’ (ঠিক আছে কি না বুঝতে পারছি না)-গানটা গাইতাম। তারপর, মনে আছে, গ্যারিসন সিনেমা হলে দেখলাম ‘দিপু নাম্বার টু’। সেই শেষ, এরপর স্টার সিনে কমপ্লেক্স হবার পর আবার কিছু কিছু বাংলা ছবি দেখা শুরু করলাম। এছাড়া বিটিভি-তে বিশেষ জাতীয় দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যে সব ছবি দেখানো হতো, সেগুলো দেখতাম। খুব ভালো লেগে গিয়েছিলো-আবার তোরা মানুষ হ, আলোর মিছিল, ওরা এগারজন। জীবন থেকে নেওয়া ছবিটা বার বার দেখেও বিরক্ত হতাম না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, বাংলাদেশের প্রথম বাংলা সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-ও পর্যন্ত বাদ যায়নি।

কর্মজীবনে এসে এপোলো হাসপাতাল আর স্কয়ার হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে মিডিয়া জগতের কিছু মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম, তাঁদের মাধ্যমেই বাংলা ছবির একটা বিশেষ ধারার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছিলো। সেই আগ্রহতেই মুক্তির মানুষ, মাটির ময়না, চাকা, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড আরো কিছু ছবি দেখেছিলাম। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেরজান এবং গেরিলা এখনও দেখা হয়ে উঠেনি। দুইটি ছবিই না কি মুক্তিযুদ্ধের উপর। একটিতে আছে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাকগ্রাউন্ডে এক পাকিস্তানী সৈন্যর সাথে এক বাংলাদেশী মেয়ের প্রেমের কাহিনী, যে মেয়ের বোন কি না পাকি সৈ্ন্য দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলো, আরেকটিতে আছে এক নিখোঁজ সাংবাদিকের স্ত্রী বিলকিসের যুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ঘটনা। একটি হয়েছে সমালোচিত, আরেকটি হয়েছে নন্দিত।

তবুও কি আমরা মুক্তিযুদ্ধের উপর কোনো কালজয়ী ছবি বানাতে পেরেছি? পেরেছি মুক্তিযুদ্ধের উপর Dances with Wolves, Hidalgo, The Patriot, Birth of a Nation, Gone with the Wind, Lion of Desert, Kingdom of Heaven, 300, Braveheart, The african Queen, All Quiet on the Western Front, Dr.Zivago, Lawrence of Arabia, Tea with Mussolini, The Bridge on the River Kwai, Casablanca, Patton, Schindler’s list, Saving Private Ryan, No Man’s Land, Life is Beautiful –এর মতো কোনো ছবি দেশবাসী, বিশ্ববাসীকে উপহার দিতে? পেরেছি কোনো ছবিতে নির্ভয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে?

ভোর হয়ে এলো। বাইরে থেকে ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে এসে লাগছে। অনেকদিন পর রাত জাগলাম। এখন বারান্দাতে গিয়ে দাঁড়াবো, ভোরের নির্মল বাতাস উপভোগ করবো। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার মনটা আর বিক্ষিপ্ত নেই।

ঢাকা, ২২/০৫/২০১১
ভোর ৫ টা