অণুগল্পঃ জীবন যেখানে যেমন

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরের বহুতল ভবনগুলো যেনো এই বৃষ্টিকে উপহাস করে। বড় বড় হাসপাতালগুলোর ভিতর থেকে তা আরো অনুভব করা যায় না। কেবিনে রোগী দেখতে এসে জানালা দিয়ে শুধু বৃষ্টির অঝোর ধারাই দেখা যাচ্ছে, শব্দগুলো অণুরনিত আর হচ্ছে না। কিন্তু এই অঝোর ধারা দেখেই দিপু কেমন উতলা হয়ে উঠলো। পালস দেখার জন্য রোগীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, পালস বিট দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে, সেখানে জায়গা দখল করেছে টাপুর টুপুর শব্দ।

“তুমি একটু অন্যরকম, অন্য সব ডাক্তারদের থেকে”
, রোগীর কথায় সচকিত হয়ে উঠে দিপু। রোগীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। “আপনিও একটু অন্যরকম, অন্য সব রোগীদের থেকে”, প্রত্যুত্তর দেয় দিপু। রোগীর নাম ভাস্কর, প্রথম দেখাতে বয়স খুব বেশি মনে হয় না। তার সাথে কথা বললে আরো কম মনে হবে। দিপু যখন ভাস্করের ব্রেনের সিটি স্ক্যান দেখে, মনে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলো। ভেবেছিলো এতো তাড়াতাড়ি এই লোক এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে! যখন জানলো বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই, যেনো কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। কথাটা ওর প্রফেসরকে বলা মাত্রই পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ প্রফেসর হেসে বলে উঠেন, “ডাক্তার হচ্ছো তাহলে এখন! পঞ্চাশের উপরে কেউ মারা গেলে আর কষ্ট লাগে না, তাই না?” চমকে উঠে দিপু, পরে অনেক ভেবেছে এই ব্যাপারটি নিয়ে। মেনেও নিয়েছে সে। অবচেতনভাবেই সে খেয়াল করেছে, অল্প বয়স্ক রোগীদের বেলায় যতটা শ্রম দেয়, বয়স্কদের বেলায় ততটা নয়। যেনো ধরেই নিয়েছে তাদের দিন শেষ।

ভাস্করেরও দিন খুব বেশি নেই। অপারেশনের আগেই তাকে বলা হয়েছিলো কাগজ কলমের সমস্ত কাজ সেরে ফেলতে। এতো বড়ো টিউমার অপারেশন করেও খুব বেশি বের করা যাবে না, এরপর আছে কেমো আর রেডিওথেরাপির ধাক্কা, এ যেনো বিধাতার কাছ থেকে কিছু সময় কেনা। অন্যান্য রোগীরা এই সময় খুব ভেঙ্গে পড়ে, কিন্তু ভাস্করের স্বভাব তা নয়। জীবনের অধিকাংশ সময় জীবনটাকে খেলা হিসেবে নেওয়া ভাস্করের কাছে এটাও যেনো একটা খেলা। হয় হারবে, নয়তো জিতবে।

অপারেশনের দুই দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে এই দুই দিনেই তার সাথে দিপুর খুব সম্পর্ক হলো। দিপুও যেমন কথা বলতে ভালোবাসে, ভাস্করও তেমন কথা শুনতে ভালোবাসে। কখনো কখনো দুই জনের কথক আর শ্রোতার ভূমিকাও বদলে যায়। দিপুর নাইট ডিউটির অধিকাংশ সময় কেটে যায় এই রুমটিতেই।
অসম বয়সের এই আলোচনায় অনেক কিছুই আসে। রাজনীতি, ধর্মনীতি থেকে শুরু করে প্রেমও পর্যন্ত। এভাবেই ভাস্কর জেনে যায় সন্ধ্যার কথা। সন্ধ্যার সাথে দিপুর পরিচয় মেডিকেলে পড়তে এসে। একই সাথে মেডিকেলে প্রবেশ ওদের। এক সাথে ক্লাস। এক সাথে আড্ডা। তারপর হঠাৎ একদিন ভালোবাসাকে পেরিয়ে একেবারে প্রেম। ঘোষনাটা আসে সন্ধ্যার কাছ থেকে, আর দিপু তখনো কাউকে ‘না’ বলতে শিখে নি।

ভাস্কর জানে, ওদের সম্পর্কটা থাকে নি, কেনো থাকে নি, দিপু তা বলে নি। ভাস্করও আর জানতে চায় নি, বুঝে নিয়েছে, এই বুড়োকে যে এতো কথা বলেছে সেটাই ঢেড় বেশি। আজ একটু পরে ভাস্করকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবে। “কবিরা বলেন, তাদের মৃত্যু যেনো হয় চাঁদনী রাতে আর আমি দেখছি বিধাতা ডাকছেন আমায় এই বৃষ্টির দিনে,” ভাস্করের কথা শুনে সহজভাবে দিপু বলে, “আপনি কি তৈরী হয়েই আছেন? সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা শত চেষ্টা করলেও ফিরে আসবেন না?”

“কিছু দিনের জন্য? মন্দ লাগবে না! এই শেষ মুহূর্তে জীবনটাকে খুব প্রিয় মনে হচ্ছে। জানো, যারা হঠাৎ করে মারা যায়, তাদের মৃত্যুর কোনো চিন্তা নেই। আর যারা জানে, সময় বেশিদিন নেই, তারা হয় খুব বেশি করে বিধাতার দিকে ঝুঁকে পড়ে, নতুবা আমার মতো জীবনটাকে উপভোগ করতে চায়, বিন্দু পরিমাণও ছাড় দিতে চায় না”।

“আর যারা প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে দেখে?”
দিপুর কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠে ভাস্কর, “ডাক্তার, শুধু তোমরাই প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে দেখো না, আরো অনেকেই দেখে। তুমি বরং তাদের কথা চিন্তা করো, যারা প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে কাটাছেড়া করে”। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় দিপু, “ডোম?”

আবারো হেসে উঠলো ভাস্কর, “তুমি আর মেডিকেল থেকে বের হতে পারলে না! তা হোক, তোমাকে বলি, যদি আজ আমি না ফিরে আসি, একটু হলেও আমার জন্য কষ্ট পেয়ো। কোনো জীবনই এতো সহজে চলে যাবার নয়, যতই সে বুড়ো হোক!”

***********************
ইমার্জেন্সীতে একটি বাচ্চা ছেলে এসেছে, রোড এক্সিডেন্টের। জ্ঞান নেই, অবস্থাও খুব ভালো নয়, মাথায় বিশাল আঘাতের চিহ্ন আছে। দিপু বাচ্চাটিকে নিয়ে খুব ব্যস্ত। ভীষনভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাঁচানোর জন্য। দীর্ঘ দুই ঘন্টা যুদ্ধ করে হেরে গেলো সে। হেরে গেলো ভাস্করও। হাসপাতালটা হঠাৎ করেই অসহ্য লাগছে দিপুর কাছে। বাইরে বেরিয়ে এলো।

বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই। গুমোট ভাবটাও নেই, বরঞ্চ কী এক অনাবিল হাওয়া! বাইরে বেরিয়ে দিপুর খারাপ লাগছে না, চিন্তা থেকে বাচ্চা ছেলেটা, এমনকি ভাস্করও নেই। আকাশে ভেসে উঠা রংধনুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কী যে হলো দিপুর! শূন্য অনুভূতি! যেনো তা দিগন্তে মিলিয়ে যাবার অপেক্ষায়।

আনমনে হেসে উঠলো দিপু, একটু পরেই হাসপাতালের দিকে পা বাড়ালো।

একটি অন্যরকম অণুগল্পঃ নীলা আর আমি

আজ সকাল থেকেই আকাশটা মুখ ভার করে গুড় গুড় শব্দে ডাকছে। নীলা ভেবেছে এই বুঝি বৃষ্টি নামলো, তাই ভার্সিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস থাকা সত্ত্বেও সে গেলো না। বরং বাদলা দিনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানাতে শুয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনার আয়োজন করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত যখন দুপুর হয়ে এলো, কিন্তু বারি পাত আর হলো না, নীলা খুব বিরক্ত হয়ে উঠলো। বিরক্তভাব কাটানোর জন্যই ঠিক করলো এখন এই আবহাওয়ার মধ্যে নাফিসার বাসায় যাবে। দুই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী জমিয়ে আড্ডা দিবে।

নাফিসাকে ফোন দিয়ে দুপুরে কোনো রকমে কিছু মুখে দিয়েই নীলা বাসা থেকে বের হয়ে এলো। সামনের মোড় থেকে মিটারের ভাড়ার চাইতে দ্বিগুন টাকায় সিএনজিতে করে যখন প্রধান সড়কের পাশে নাফিসার বাসার সামনে আসলো, তখনই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো।

প্রায় ভিজা অবস্থায় নীলা নাফিসার বাসায় ঢুকেই আমাকে দেখে মনে হলো ভুত দেখার মতো চমকে উঠেছে। আমি নিয়াজ, নাফিসার খালাতো ভাই। আমি আর নাফিসা ছয় মাসের বড়ো-ছোটো, তুই-তোকারি সম্পর্ক। নাফিসা আর নীলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাতে পড়ছে আর আমি নামের আগে ডাক্তার শব্দ বসানোর জন্য প্রানান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছি, থাকি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে। নাফিসার সাথে নীলার বন্ধুত্ব সেই স্কুল থেকে । ওরা দুইজনেই একই স্কুল, এরপর একই কলেজ এবং এখন একই ভার্সিটিতে একই সাবজেক্টে পড়ছে। বন্ধু বলে একেই!

নাফিসার খালাতো ভাই হবার সুবাদে নীলার সাথে আমারো সেই আদিকাল থেকেই পরিচয়। নাফিসার অগোচরে নীলার সাথে সেই পরিচয় থেকে পরিণয় কখন যে শুরু হয়েছে, তা আমি নিজেও ভুলে গেছি। নীলা জানে না, আমার সাথে ওর সম্পর্কের কথাটা আমি যে নাফিসাকে বলেছি। ও চায় নি নাফিসা আমাদের সম্পর্কের কথাটা জানুক। মেয়েরা পারেও বটে! খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে না জানিয়ে তার খালাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করা!

গত দুই দিন ধরে নীলার সাথে আমার ঝগড়া চলছে, সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে। গত দুইদিন আগে ওর সাথে দেখা করতে আমি একটু দেরি করেছি। কেনো আমি দেরি করেছি, এটাই আমার অপরাধ। তাই, নীলা এই দুইদিন আমার ফোন রিসিভ করছে না, সেও ফোন করছে না। আমি নাফিসাকে বলে রেখেছিলাম নীলা ওদের বাসায় যখনই আসবে, আমাকে যেনো খবর দেয়। নাফিসা একটু আগে আমাকে খবর দিয়েছিলো।

আমি যখন নাফিসার বাসায় এলাম, তখনই আমার ছোট বোনের বর আমাকে ফোন দিলেন, “ভাইয়া, ডাক্তার বলছে রিদিতার সিজার করতে হবে এখন। আপনার সময় থাকলে কি আপনি একটু আসতে পারবেন?” আমি এখনও ডাক্তার না হলেও, পরিবারের একমাত্র মেডিকেল পড়ুয়া ছেলে হিসেবে যে কোনো হাসপাতাল সংক্রান্ত কাজে আমার ডাক পড়বেই। আমার বোন রিদিতার সিজারের তারিখ যে আজকেই পরবে, কে যে ভেবেছিলো! এদিকে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি বিষণ্ণমনে নাফিসার বাসা থেকে বের হবার সময়ই নীলা এলো। ওর চমকে যাওয়া প্রশ্নবোধক চোখের সামনে দিয়ে আমি কিছু না বলেই বাইরে চলে আসলাম। নীলা পিছন ফিরে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।

নাফিসার রুমে ঢুকেই বললো, “কি রে, তোর পাজী, হতচ্ছাড়া ভাইকে দেখলাম মনে হলো!” কোনো রকমে না হেসে নাফিসা গম্ভীরভাবে বললো, “হ্যাঁ, আমার কাছে এসেছিলো একটা পরামর্শের জন্য। ওর মেডিকেলের জুনিয়র একটা মেয়ে গতকালকে ওকে ভালোবাসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ও হ্যাঁ বলবে, না কী, না বলবে, সে ব্যাপারে আমার মূল্যবান মতামত নিতে এসেছিলো।” নীলা ভুরু কুচকিয়ে কি যেনো বলতে গিয়ে থেমে গেলো। নাফিসার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, “চল, ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজি।”

দুই বান্ধবী মনের আনন্দে সেই ছোট্ট বেলার মতো বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। এক সময় নাফিসা বলে ফেললো, “জানিস, আজ নিয়াজ, মামা আর আমি খালা হতে যাচ্ছি।”
-মানে?
-মানে, আজ আর একটু পরে নিয়াজের ছোট বোন রিদিতার সিজার হবে, বুঝেছেন নীলামনি?

নীলা আজকের দিনে দ্বিতীয় বারের মতো চমকে উঠলো। ও জানতো, নিয়াজ বলেছে, রিদিতা মা হতে যাচ্ছে। সেটা যে আজকেই হবে নীলা বুঝতে পারে নি, আসলে বোঝার কথাও না। নীলার আর বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে না। নিয়াজের প্রতি গত দুইদিন ধরে জমে থাকা রাগটাও পানি হয়ে গেলো। খুব ইচ্ছে করছে নিয়াজের সাথে ফোনে কথা বলতে। কিন্তু নীলা কোনোভাবেই নাফিসার সামনে নিয়াজকে ফোন দিবে না। নাফিসাও বান্ধবীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো, “চল, রুমে যাই, আরেকটু ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে।”

নীলা ওর ভিজা পোশাক খুলে নাফিসার একটা পোশাক পরলো। নাফিসা চা বানানোর কথা বলে রান্নাঘরে যাওয়া মাত্রই নীলা নিয়াজকে ফোন দিলো।
-কি খবর নিয়াজ? রিদিতার কি অবস্থা?

ফোনে নীলার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর শুনে কেনো জানি না, আমার খুব ভালো লাগলো। আমার পরিবারের প্রতি ওর এই দরদের জন্যই ওকে আমি আরো বেশী পছন্দ করি। দুষ্টু কন্ঠে বললাম, “তুমি দুই মিনিট আগে মামী হয়েছো!” নীলা আমার কথা শুনে হেসে ফেললো। আরো কিছুক্ষণ নীলার সাথে কথা বলে এবং আগামীকালকে কোথায়, কখন দেখা করবো জেনে নিয়ে ফোন রেখে দিলাম।

আমার অসম্ভব আনন্দ লাগছে। আজ আমি মামা হয়েছি। মামা শব্দটার মধ্যেই একটা আলাদা ভাব আছে। আমি আবার নিয়মিতভাবে ব্লগিং করি। পিচ্চি বাবুর ছবি মোবাইলে তুলে নিয়েই হোস্টেলে চলে এলাম। দ্রুত ল্যাপটপ ওপেন করে নেটের কানেকশন দিয়ে ব্লগে ঢুকে লেখা শুরু করলাম আমার পিচ্চি ভাগনিকে নিয়ে। লেখা যখন প্রায় শেষ, নাফিসা আমাকে ফোন দিলো।
-হ্যলো, নিয়াজ, তুই কোথায়?

ফোনে ঠিকমতো নাফিসা কথাও বলতে পারছে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নাফিসা আর নীলা, দুই বান্ধবী, জমিয়ে আড্ডা দেবার পর একটু আগে নীলা বললো রাত হয়ে যাচ্ছে, বাসায় যাবে। নাফিসার বাসার সামনে কোনো সিএনজি না পেয়ে রাস্তা অতিক্রম করে আরেক পাশে যাবার সময় দ্রুতগতিতে আসা এক বাসের ধাক্কায় নীলা ছিটকে পড়ে। পুরো ব্যাপারটাই ঘটে নাফিসার চোখের সামনে।

ফোনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নাফিসা নিয়াজকে বলতে থাকে, “নিয়াজ, নীলা আর নেই। একটু আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে!”

পরিশিষ্টঃ

“মামা, এই জন্যই তুমি তাহলে এই জীবনে আর বিয়ে করলে না! এতো ভালবাসতে আন্টিটাকে!” ওর কথা বলার ধরনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম, বললাম,
-এই তো, তুই তাহলে বুঝতে পার লি।
-মামা, তুমি কী আমাকে এই আন্টির নামেই নীলা ডাকো?
একটু চুপ থেকে, একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, তোকে আমি ওর নামেই ডাকি, নীলা!”

এটি একটি গল্প, কোনো সত্যি কাহিনী নয়…

সমুদ্র শ্রুতির খুব ভালো লাগে। সেই ছোটবেলায় একবার স্কুল থেকে সমুদ্রে অবগাহন করতে কক্সবাজার গিয়েছিলো।সমুদ্রের বিশালতায় ওকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল কিন্তু অবগাহনে মনটা কি এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠেছিল, তা এত বছর পর এখনো মনে করতে পারছে।এখনো কান পাতলে সে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পায়, ভাবে আবার কবে যাবে। কি মজাটাই না করেছিলো সেবার।চিন্তা করতে করতে শ্রুতির বুক থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠল শ্রুতি।দ্রুত মুক্তা আপার বাসায় যেতে হবে, আজকে রাতে নাকি একটা ভালো পার্টি আসবে। সকালে মুক্তা ফোন দিয়ে বলেছিলো রাতে কোনো কাজ না রাখতে, ছেলেটাকে খুশি করতে পারলে ভালো টাকা পাবে। বড় লোকের ছেলে, মাঝে মাঝে খেয়াল হলে আসে এবং আসলে তাকে সবচেয়ে ভালোটাই দিতে হবে, সে জন্য মুক্তা শ্রুতিকে ফোন করেছিলো।

মুক্তার প্রতি শ্রুতি খুব কৃ্তজ্ঞ।ওদের বিপদে একমাত্র মুক্তাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।শ্রুতি অবশ্য এই লাইনে আসতে চায়নি। কিন্তু হঠাৎ করে ওর বাবা মারা যাওয়াতে ওরা বাস্তবিক অর্থেই বিপদে পড়ে গিয়েছিলো।তিন ভাই বোনের মধ্যে ওই সবচেয়ে বড়, ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে, ছোট দুই ভাই এখনো কলেজের গন্ডি পেরোয় নি। বাবা একটি স্কুলে করণিক পদে কাজ করতো, খুব বেশী সৎ ছিলো মনে হয়, মৃত্যুর পর তার কোনো ব্যাংক একাউন্টের খোঁজ পাওয়া যায়নি, সঞ্চয়-ও খুব একটা করতে পারেনি।শ্রুতির মা তার কলেজ পড়ুয়া দুই ছেলে আর ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ের খরচ চালাতে গিয়ে চোখে অন্ধকারই দেখছিল, তার উপর আবার সাথে আছে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত শ্রুতির দাদী। শ্রুতি পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য একটা পার্টটাইম চাকরি পাবার অনেক চেষ্টা করেছিলো। অভিজ্ঞতার অভাব ছিল, তাই চাকরিও মিললো না।যেখানে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই, সেখানে নর মানুষের লোভী চোখের অভাব নেই, কিন্তু বেতন কম।

ঠিক এই সময়েই মুক্তা এগিয়ে আসে।একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে মুক্তার সাথে পরিচয়, সেখানকার রিসেপশনিষ্ট।ইন্টারভিউ রুম থেকে যখন বিষন্ন নয়নে বের হয়ে আসলো তখন মুক্তা শ্রুতির হাতে ফোন নম্বরটি দিয়ে বলেছিলো ফোন করতে।

এখন সে প্রায়ই মুক্তার ফোনের অপেক্ষায় থাকে। মাসে মাত্র কয়েক টা রাত থাকা লাগে, কিন্তু পকেট ভারী হয়। বাকী সময়টাতে সে পড়াশোনা করতে পারে। মুক্তার সাথে কথা বলার পর প্রথমে সে রাজীই হয়নি, পরে প্রয়োজনের তাগিদে রাজী হয়। প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি লাগতো, নিজেকে অশুচি অশুচি লাগতো, এখন আর লাগে না।মাঝে মাঝে সমুদ্র-অবগাহনের কথা মনে পড়ে যায়, ভাবে কোনো একদিন সমুদ্র সঙ্গমে শুদ্ধ হয়ে আসবে।

বাসা থেকে বের হবার সময় মা-কে বললো আজ রাতে সে বান্ধবীর বাসায় থাকবে, ক’দিন পর পরীক্ষা, একসাথে পড়বে। মা কিছু বলেনি, কখনো বলেনা, মা জানে শ্রুতি যেদিন রাতে বান্ধবীর বাসায় থাকে, তার পরের কয়েকটা দিন ভালো খাওয়া-দাওয়া হয়, সংসার খরচে বাড়তি কিছু টাকা আসে। সে কখনো শ্রুতিকে জিজ্ঞেস করেনি, কিভাবে টাকা আসে, কখনো জিজ্ঞেস করতেও চায়না, পাছে অপ্রিয় কথা শুনতে হয়।

মুক্তার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবে গেলো। শ্রুতি সবসময় আগে আগে আসে, এসে বিশ্রাম নেয়, একটু মেকাপ লাগায়, নিজেকে মোহনীয় করে তোলার যাবতীয় চেষ্টা চলে। মুক্তা বলছে আজকের ছেলেটা বিশাল বড় লোকের ছেলে, মাঝে মাঝে আসে, ভালো লাগলে প্রচুর টাকা দেয়।ব্যবহার ভালো, দেখতেও রাজপুত্রের মতো।মুক্তার কথায় শ্রুতি হেসে ফেলে। রাজপুত্র শুনে ওর সমুদ্রের কথা মনে পড়ে যায়।

এই সমুদ্র, সেই সমুদ্র নয়। ওদের ভার্সিটিতে পড়ে, দুই ব্যাচ সিনিয়র, সবার মাঝে খুব জনপ্রিয়। চেহারা রাজপুত্রের মতোই, বাবার মনে হয় কয়েকটা ইন্ডাস্ট্রি আছে। শ্রুতির হৃদয়েও এই সমুদ্র দোলা লাগায়, মনে মনে খুব করে চায় এই সমুদ্রেও অবগাহন করতে।কিন্তু কখনো কথা বলারও সুযোগ হয়নি, সমুদ্র-সঙ্গম তো দূরের কথা, সমুদ্র বোধহয় ওকে চিনেই না। ওর বুক থেকে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

শ্রুতি রুমে একা বসে আছে। রাজপুত্রের মতো দেখতে ছেলেটা মাত্র এসেছে, মুক্তার সাথে কথা বলছে। কিছুক্ষন পরই এই রুমে ঢুকবে।শ্রুতি দরজার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে……..।

এ যে সমুদ্র! শ্রুতি পাথরের মতো ঠায় বসে আছে।চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে, আনন্দে না কষ্টে বুঝতে পারছে না, শুধু বুঝতে পারছে সে আবার সমুদ্রে অবগাহনে যাচ্ছে, সমুদ্র-সঙ্গমে সে শুদ্ধ হয়ে উঠবে, নীল-আকাশের মতো শুদ্ধ।

কেওয়াইএএমসিএইচ,
০৭/০৫/২০১১