সরল রেখা-বক্র রেখাঃ ১৭তম পর্ব


( সরলরেখা – বক্ররেখাঃ ৩য় পর্ব
সরলরেখা – বক্ররেখাঃ ৭ম পর্ব
সরলরেখা – বক্ররেখাঃ অন্যান্য লেখকদের লেখা বাকী পর্বগুলো

সরলরেখা – বক্ররেখা — এই বারোয়ারি উপন্যাসটি এবারের ২১শের বইমেলাতে অন্যপ্রকাশ থেকে বের হচ্ছে)

আজ শুক্রবার। বন্ধের দিনে মিলন ঘুম থেকে উঠতে সবসময় একটু দেরী করে। সপ্তাহে এই একটি দিনেই ও যতো ঘুমিয়ে নিতে পারে। কিন্তু আজ বেশীক্ষণ ঘুমাতে পারলো না। গতকাল রাতেই সে সিরাজের মায়ের কুলখানি শেষ করে ঢাকায় এসেছে, শরীর এবং মন দুটোই খুব ক্লান্ত, তারপরও খুব সকালেই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। রুমের জানালা দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ ওর গায়ে এসে পড়ছে। বিছানাতে আধশোয়া হয়েই সে গত কয়েকদিনের কথা চিন্তা করছে।

চারদিন আগে হঠাৎ করে যখন হাবিবের কাছ থেকে সিরাজের মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পায়, প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। তারপর কোন কিছুই চিন্তা না করে দ্রুত চট্টগ্রামের দিকে রওয়ানা দেয়। সেখানে পৌঁছে সিরাজকে যতটা বিধ্বস্ত দেখবে ভেবেছিলো, তা না দেখে যেনো কিছুটা হতাশই হয়েছিলো। ভেবেছিলো পুরানো বন্ধুর এই বিপদের দিনে তার পাশে দাঁড়িয়ে নিকট অতীতের ছিন্ন সম্পর্কটাকে আবার জোড়া লাগাবে। সিরাজকে তার আন্তরিকই মনে হয়েছে, মনে হয়েছে পুরানো ইয়ার দোস্তকে কাছে পেয়ে সে খুবই উচ্ছ্বসিত, কিন্তু তাকে বা হাবিবকে সে কোনো কাজেই ডাকে নি। মাঝে মাঝে দেখা গেছে শামার পরামর্শ নিতে। একদিক থেকে অবশ্য ভালোই হয়েছে, সিরাজকে নিয়ে আর হাবিবকে নিয়ে সে অনেক চিন্তা করার অবসর পেয়েছে। আর অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়েছে সেলিনার কাছ থেকে কিছু পুরানো ক্ষতের প্রলেপ।

মরা বাড়ির ভীড়ের মধ্যে যখন সেলিনা মিলনের কাছে এসে বলে ওর সাথে কিছু কথা আছে, মিলন একটু অবাকই হয়েছিলো। তারপরও একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে সে সেলিনার সাথে কথা বলতে এগিয়ে যায়।

মিলন ভাইয়া, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সেদিন যদি আপনি আমার সাথে ওরকম ব্যবহার না করতেন, আমি হয়তোবা আজকের এই আমি হতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম না কিশোরী বয়সের সাময়িক আবেগের সাথে বাস্তব জীবনের কঠোরতার প্রভেদ। আপনার সেই চাবুকের কষাঘাতের মতো ‘না’ শব্দটিই যেনো আমাকে বাস্তবে নিয়ে এসেছে। প্রথম দিকে আপনাকে আমি অনেক ভুল বুঝেছি, ভীরু, কাপুরুষ ভেবেছি। কিন্তু কখনো বুঝতে চাই নি আপনার অবস্থাকে, মেনে নিতে পারি নি আমার জন্য, ফুপার অপমানজনক কথা শুনে আপনার অসহায়ভাবে বাসা থেকে চলে যাওয়াটাকে। মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো আমাদের পবিত্র ভাই-বোনের মতো সম্পর্কটাকে বাইরের কিছু লোকের অযাচিত কালি লেপনে। আমি হয়ে গিয়েছিলাম বিধ্বস্ত, এলোমেলো এক কিশোরী, যে তখন জীবন সাগরে ভেসে থাকার জন্য খড়কুটোও আকড়ে ধরতে চেয়েছিলো। এখন মনে হয়, যা কিছু হয়েছে সব বুঝি সবার মঙ্গলের জন্যই। আজ শুধু একটা অনুরোধই করবো আপনাকে, পারবেন সেই আগের মতো আমাকে ছোটবোন হিসেবে দেখতে? আপনি, সিরাজ ভাইয়া আর ভাইয়া, আপনারা তিনজন আমাদের বাসায় খাবার খেতে বসবেন, ছোটবোন হিসেবে আমি আপনাদেরকে আমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করে খাওয়াবো-পারবেন ভাইয়া আমার এই স্বপ্নটাকে সত্যি করতে?

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চোখের পানি মুছতে মুছতে যেনো সেলিনা মিশে গেল ভীড়ের মধ্যে, মিলন যেনো দাঁড়িয়ে রইলো হতবিহ্বল হয়ে স্থাণুর মতো। কিন্তু একইসাথে ওর মনে হলো, বুক থেকে যেনো এক বিশাল কষ্টের পাথর নেমে গেলো, অনেক দিনের একটা ক্ষতের উপর যেনো এক মায়ার, এক অন্যরকম বন্ধনের প্রলেপ পড়লো। বুক ভরা এক নিশ্বাস নিয়ে হেসে ফেললো মিলন, দূর থেকে দেখতে লাগলো অপসৃয়মান সেলিনাকে। মনটা ভরে উঠলো এক অনাবিল আনন্দে।

রুমমেটের ডাকাডাকিতে বর্তমানে এসে মিলন একটু হকচকিয়ে গেলো, তারপর ধাতস্থ হয়ে স্মিত হেসে বললো, “রুপম, তুই তো বাংলার ছাত্র, তাই না? রবীন্দ্রনাথের ‘অচল স্মৃতি’ কবিতাটি জানিস? আমার কিছু স্মৃতি অচল হয়ে গেছে”। রুপম মিলনের কথার মানে বুঝতে না পারলেও আগ্রহভরে আবৃত্তি করতে লাগলো-

“আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি ।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি………”

সাদা চাদরে আবৃত সুফিয়া খাতুনের বেডের পাশে চোখ-মুখ শুকনো করে কেমন স্থবির হয়ে বসে আছে সিরাজ। অনেক কিছুই ওর মনে আসছে, আবার চলেও যাচ্ছে। সেই ছোটবেলা থেকে এই আজ পর্যন্ত-সবকিছুই। সিরাজের বাবা অল্প বয়সে মারা যাবার পর সংসারের হাল ধরেন সুফিয়া খাতুন। গ্রামের বাড়িতে কীভাবে ছেলেকে বড় করে শহরের স্কুলে পড়িয়েছেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন। ছেলে আস্তে আস্তে বড় হলো, পড়াশোনা না করে টেকনিক্যাল লাইনে চলে গেলো। সুফিয়া খাতুন না করেন নি, সংসারে কিছু অর্থের সমাগম হবে এই আশায়। সিরাজ যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো, গ্রাম থেকে এসে আর যেতে চাইলেন না তিনি। সিরাজ সুস্থ হয়ে একটা বুটিকের দোকানের ব্যবস্থা করে দেয় মা কে। মা-ছেলে যখন একসাথে থাকবে, তখনই সিরাজ জেলে যায়। সুফিয়া খাতুন ছেলেকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, তাই ছেলের নেশা করা, বন্ধুদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, সবকিছুতেই প্রথমে আপত্তি করলেও, পরে তা মেনে নিতেন। সিরাজও তার মাকে খুব ভালোবাসত। বাইরের দুনিয়াতে তার সমস্ত দস্যুপনা মায়ের কাছে এসে শেষ হয়ে যেতো। সেই মায়ের হঠাৎ মৃত্যু যেনো সিরাজকে আক্ষরিক অর্থেই কিছুক্ষণের জন্য স্থবির করে দিলো।

শামা যখন ক্লিনিকে এসে সিরাজকে এভাবে দেখে, তখনই সিরাজ নিজেকে সামলে নেয়। ঠিক করে ওর কষ্টটাকে ও কাউকে বুঝতে দিবে না, ওর মায়ের শেষ কাজ ও নিজের হাতেই সব করবে। ঢাকা থেকে মিলন ছুটে আসে, হাবিবও আসে ওকে সঙ্গ দিতে। সবার সাথেই সে পুরানো দিনের মতোই ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে শামা এসে ওকে কিছু পরামর্শ দিয়েছে , ও শুনেছে, কিন্তু সব কাজ নিজের মতো করেই করেছে। নিজেকে শান্ত রেখেছে, চোখের পানিটুকু পর্যন্ত ফেলার অবকাশ দেয় নি। এমন কি মাকে কবরে রেখে এসেও নিজেকে ধরে রেখেছে।

কিন্তু কুলখানির পর যখন মিলন, হাবিব চলে গেলো, যেসব আত্মীয়-স্বজন এসেছিলো, তারা যখন বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে নিজেদের পথের দিকে রওয়ানা দিলো, ও যখন শূন্য, ফাঁকা ঘরটাতে একা ফিরে এলো, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। মায়ের শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো। গলার কাছে দলার মতো আটকে থাকা সমস্ত কিছু যেনো এক নিদারুণ চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে এলো।

“বন্ধন ? বন্ধন বটে , সকলি বন্ধন —
স্নেহ প্রেম সুখতৃষ্ণা ; সে যে মাতৃপাণি
স্তন হতে স্তনান্তরে লইতেছে টানি ,
নব নব রসস্রোতে পূর্ণ করি মন
সদা করাইছে পান । স্তন্যের পিপাসা
কল্যাণদায়িনীরূপে থাকে শিশুমুখে —
তেমনি সহজ তৃষ্ণা আশা ভালোবাসা
সমস্ত বিশ্বের রস কত সুখে দুখে
করিতেছে আকর্ষণ , জনমে জনমে
প্রাণে মনে পূর্ণ করি গঠিতেছে ক্রমে
দুর্লভ জীবন ; পলে পলে নব আশ
নিয়ে যায় নব নব আস্বাদে আশ্রমে ।
স্তন্যতৃষ্ণা নষ্ট করি মাতৃবন্ধপাশ
ছিন্ন করিবারে চাস কোন্‌ মুক্তিভ্রমে!”

শামার যে কী হলো, শামা নিজেই যেনো তা বুঝতে পারছে না। সিরাজের মায়ের মৃত্যুর পর সিরাজের কঠিন কিন্তু কোমল ব্যবহার দেখে শামা যেনো নিজেকেই স্থির রাখতে পারছিলো না। বার বার ভেবেছে, এই বুঝি সিরাজ ভেঙ্গে পড়লো, ছুটে গেছে সিরাজের কাছে, কিন্তু দেখেছে এক নিষ্কম্প সিরাজকে। কী অদ্ভুত সুন্দরভাবেই না সব কাজ শেষ করলো সিরাজ! মাঝে মাঝে কিছু পরামর্শ দিতে গিয়েছিলো, সিরাজ শুনেছে, কিন্তু কাজ করেছে নিজের মতো করে। মায়ের মৃত্যু যেনো সিরাজকে অনেক পরিবর্তন করে ফেললো। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো শামা।

সব কাজ শেষ করে একটু স্থিতি হতেই সিরাজের সাথে দেখা করতে গেলো শামা। খুব শান্তভাবে বলতে লাগলো,

তুই হয়তোবা জানিস না, আমি এবরশন করিয়েছি। হ্যাঁ, আমার মনের সাথে আমাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে, অনেক রাত আমার নিদ্রাহীন কেটেছে, তুই শুনে অবাক হবি, বোধহয় একটু রাগও করতে পারিস, মনে মনে কয়েকবার আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছি। কিন্তু কেনো জানি না, শেষ মূহুর্তে এই জীবনটাকে খুব ভালবেসে ফেললাম, নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চাইলাম। নাফিস আর নাফিস সংক্রান্ত সব ঝেড়ে ফেললাম। নতুন করে এই পথ চলায় হঠাৎই মনে হলো তুই সাথে থাকলে আমি খুব শক্তি পাবো, তুই সাথে থাকলে সব বাধা বিপত্তিটাকে পেরিয়ে যেতে পারবো। এক সময় তো তুই চেয়েছিলি আমার এই হাতটাকে ধরতে, আমি দিতে চাই নি, আজ আমি তোর হাত ধরতে চাইছি, শক্ত করে, তুই কি ধরতে দিবি না? জানি আমি, তোর শরীরে এক কঠিন রোগ বাসা বেধেছে, হয়তোবা খুব বেশী দিন তুই আমাদের সাথে নেই, কিন্তু যে ক’টা দিন আছিস, তোকে কি আমি আমার পাশে পাবো না?

হাবিব সিরাজের মায়ের কুলখানি শেষ করে বাসায় এসেছে। সেলিনাকে বললো এক কাপ চা করে দিতে। কিছুক্ষণ আগে মিলনকে ঢাকার বাসে তুলে দিয়েছে, মিলনের সাথে কথা বলে মনে হোল সেলিনার সাথে দূরত্বটা মনে হয় কেটে গেছে। খুব ভালো লাগলো হাবিবের। পুরানো অনেক কিছুই স্মৃতিপটে খেলা করে গেলো। মিলন আর সিরাজ – এই দুইজন ওদের জন্য অনেক করেছে, হাবিব চায় নি ওদের এই বন্ধুত্বের পথচলাটা যেনো বক্র রেখায় শেষ হয়, সবসময় চেয়েছে তা যেনো সরল রেখার মতো অন্তহীনভাবে চলে। যেমনভাবে চেয়েছে মিলির সাথে ওর সম্পর্কটার পরিণতি।

ঢাকাতে যেদিন মিলি আর শিহাবের সাথে ওর দেখা হলো, ও খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলো। মনে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে শিহাবকে ওর বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতোই মনে হয়েছিলো। মিলি খুব বুদ্ধিমতীর মতো শিহাব আর সিরাজকে সরিয়ে দিয়েছিলো। হাবিব ভেবেছিলো, সমস্ত ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাবে। কিন্তু মিলির কথা শুনে ও যেনো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো, কিছু সময়ের জন্য মুখে যেনো কোনো কথাই আসছিলো না। চট্টগ্রামে ফিরে এসে একা একা চিন্তা করে হাবিবের মনে হোল এই বেশ ভালো হয়েছে। সেলিনার দিয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যেনো হাবিবের কানে মিলির সেই কথাগুলোই বাজছিলো-

হাবিব ভাই,তুমি আমার সেই ছোটবেলা থেকে, যখনো ভালোবাসা কাকে বলে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারি নি, তখন থেকেই আমার মনে কিসের অনুভূতি যেনো সৃষ্টি করতে। তোমার সাথে খেলতে, তোমার সাথে কথা বলতে, তোমার সাথে ঝগড়া করতে, সবসময় তোমার পাশে থাকতে আমার খুব ভালো লাগতো। একটু বড়ো যখন হতে লাগলাম, ভালোবাসা শব্দটি যখন পরিচিত হতে লাগলো, মনে হলো, এটাই বুঝি ভালোবাসা। তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে লাগলাম। তোমাকে নিয়ে অনেক রঙ্গিন স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলাম। তুমি ঢাকায় আসার পর মনে হলো, এইবার আমি তোমাকে আমার মতো করে পাবো। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, বিধাতা ভাবেন আরেক। তুমি এক্সিডেন্ট করলে, অসুস্থ হয়ে প্রায় এক বছরের মতো হাসপাতাল আর পুনর্বাসন কেন্দ্রে রইলে। বিশ্বাস করো, সেই সময়টা আমি অসম্ভব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম, নিজেকে যেনো তিলে তিলে নিঃস্ব করে ফেলছিলাম। এমন সময়ই শিহাব এগিয়ে আসে আমাকে এই স্বেচ্ছা বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে। লাভগুরু, নির্ঝর আর কায়েস হয়ে যায় প্রতি রাতে আমার ভালোবাসার শিক্ষক। আমি যেনো নতুন করে ভালোবাসাকে বুঝতে শিখি, জানতে শিখি। ভালোবাসা যেনো একটু একটু করে আমার কাছে উন্মুক্ত হতে থাকে। আমি সেই সময়টাতেও তোমাকে নিয়ে ভেবেছি, কিন্তু জানো কী, অবাক হয়ে আমি আবিষ্কার করলাম, তোমার সাথে আমার কোনো ভালোবাসার দৃশ্য মনের কোনো ফ্রেমে নেই, ভালোবাসার জন্য উন্মুখ এই কিশোরী মিলি তোমাকে ভালোভাবে বোঝার কোনো সুযোগই পায় নি। হাবিব ভাই, আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসতে চাই, কিন্তু আমাকে একটু সময় দিবে কী? ভয় নেই, শিহাব আমাকে আর ভালোবাসে না, পৃথিবীর কোনো একপ্রান্তে হয়তোবা ওর জন্য কোনো এক রেমি অপেক্ষা করে আছে। আমি শুধু চাই, তোমাকেই ভালবাসতে, নিজের মতো করে ভালবাসতে, যে ভালোবাসাকে আমি চিনেছি, জেনেছি, সেই ভালোবাসায় আমি তোমাকে আলিঙ্গন করতে চাই, শুধু তার আগে চাই কিছুটা সময়, যেই সময়ের ভিতর আমি তোমাকে আরো নিগূঢ়ভাবে বুঝতে পারবো। আমি জানতে পারবো, খুঁজতে পারবো, এই আমি, মিলি, তোমাকে আসলেই ভালোবাসি কতটুকু, কতটুকু খাঁটি সেই ভালোবাসা। তুমি কী দেবে না আমায় সেই সময়টুকু?

হাবিব এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চায়ের কাপটা রাখতেই সেলিনার রুম থেকে শুনতে পেলো জিম ক্রসের গাওয়া ওর খুব প্রিয় একটা গান-

“Well, I know it’s kind of late
I hope I didn’t wake you
But what I got to say can’t wait I know you’d understand
Ev’ry time I tried to tell you
The words just came out wrong
So I’ll have to say I love you in a song

Yeah, I know it’s kind of strange
But ev’ry time I’m near you
I just run out of things to say
I know you’d understand
Ev’ry time I tried to tell you
The words just came out wrong
So I’ll have to say I love you in a song

Ev’ry time the time was right
All the words just came out wrong
So I’ll have to say I love you in a song

Yeah, I know it’s kind of late
I hope I didn’t wake you
But there’s something that I just got to say
I know you’d understand
Ev’ry time I tried to tell you
The words just came out wrong
So I’ll have to say I love you in a song”.

সরল রেখা-বক্র রেখাঃ সপ্তম পর্ব

সরল রেখা-বক্র রেখাঃ ১ম থেকে ৬ষ্ঠ পর্ব

অনেক দিন আগে মিলি তখন ছোট, বাবা-মায়ের সাথে মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। লাল একটা ফ্রক পরে সারাদিন মামাতো ভাই-বোন হাবিব আর সেলিনার সাথে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতো। হাবিবের তখন একটা সাইকেল ছিলো, সেই সাইকেলে চড়ে অনেক দূরে চলে যেতো ওরা তিনজনে। গ্রামের ডোবা থেকে শাপলা তুলে আনতো, কখনো গাছের ডালে উঠে বসতো আবার কখনোবা সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে কান্না করে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরতো। একদিন সাইকেলে করে একসাথে বাসায় ফিরবার সময় এক রিকশার সাথে সংঘর্ষে পড়ে গিয়ে হাবিবের দুই হাতের কনুই ছিলে রক্ত ঝরতে লাগলো। সাদা ফুল হাতের সার্টে রক্তটা একটু বেশিই রক্ত লাগছিলো! মিলি সহ্য করতে পারে নি, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো।

শুক্রাবাদে রাস্তা পার হতে গিয়ে যখন বিদ্যুত গতিতে ধাবমান প্রাইভেট গাড়ির ধাক্কায় হাবিব ছিটকে পড়ে, মিলি তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারে নি। বরঞ্চ মিলি ধাতস্থ হবার আগেই আশে পাশের কিছু মানুষ হৈ হৈ করে কয়েকটি বাস আর প্রাইভেট কার ভেঙ্গে ফেলে। মিলি যখন রক্তে ভিজে যাওয়া হাবিবের মাথাটা ওর বুকে জড়িয়ে ধরে, সাদা স্কুল ড্রেসটা যখন গাঢ় রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠে, তখনো কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না। হাবিবের দিকে তাকিয়ে শুধু বিড়বিড় করে ‘রক্ত, রক্ত’ বলে যাচ্ছিলো। এক সত্যিকারের বয়স্ক মানুষ যখন অজ্ঞান হাবিবকে সবচেয়ে কাছের স্কয়ার হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে নিয়ে গেলো, তখনো মিলি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না, শুধু অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর রক্তে রাঙা হাতের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে ‘রক্ত, রক্ত’ বলে যাচ্ছিলো।

ইমার্জেন্সী ডাক্তার ছিলো রাহাত, মিলির কলেজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নওশাবার বড়ো ভাইয়া। নওশাবাদের বাসায় যাওয়ার সুবাদে মিলি রাহাতকে এবং রাহাত মিলিকে চিনতো। রাহাতই শেষ পর্যন্ত মিলির বাবা হাসান সাহেবকে ফোন করে হাবিবের এক্সিডেন্টের খবর জানায়। প্রায় সাথে সাথেই মিলির বাবা- মা হাসপাতালে চলে আসে। হাবিবের মাথার সিটি স্ক্যান করার পর ব্রেনের ভিতরে রক্তপাত দেখা যায়। সংকটাপূর্ণ অবস্থায় ওকে নিউরো আইসিইউ-তে ভর্তি করানোর পরেই মিলি হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
————————————

সিরাজের রক্তের গ্রুপ ছিলো এ নেগেটিভ। কীভাবে যেনো শামার অফিসের কলিগ নাফিসের রক্তের গ্রুপও ছিলো এ নেগেটিভ। এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে সিরাজকে দ্রুত অবনতির হাত থেকে রক্ষা করে এখন জেনারেল ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। সিরাজের মা-কে খবর দেওয়ার পর উনি গ্রাম থেকে আসা অবধি সুর করে বিলাপই করে যাচ্ছেন। এক সময় শামার মনে হলো উনাকে খবর না দিলেই মনে হয় ভালো হতো। মিলন সেলিনাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা দেবার পরই শামা হঠাৎ করে অসহায় বোধ করতে লাগলো। ডাক্তারদের আচরণে যেনো আরো কুকড়ে যাচ্ছিলো সে। বহু কষ্টে একজন ডাক্তারকে পাওয়া যাবার পর, সে সিরাজকে একটু দেখে সিস্টারকে কি কি রক্ত পরীক্ষা করতে হবে বলে কোথায় যেনো আবার চলে গেলো। এই সময় যদি নাফিস না থাকতো, তাহলে শামা একা সামলাতে পারতো না। যখন জানা গেলো সিরাজের রক্তের গ্রুপ এ নেগেটিভ, নাফিস নিজে থেকেই রক্ত দিতে এগিয়ে আসলো।

নাফিসের সাথে শামার পরিচয় বেশি দিনের নয়। শামা বিদেশী এনজিওটির যে ব্রাঞ্চে কাজ করে, সেই ব্রাঞ্চের প্রধান হয়ে কিছু দিন আগে নাফিস আসে। মার্জিত, সুদর্শন নাফিসকে প্রথম দিন থেকেই অফিসের সবাই পছন্দ করা শুরু করে। বস সুলভ অহমিকার চাইতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই যেনো নাফিসের কাজের মূলমন্ত্র। সহকর্মীদের কাজের স্বাধীনতায় সম্পূর্ণ বিশ্বাসী সে। অন্যদিকে শামা ছোট বেলা থেকেই আত্মসচেতন, স্বাধীনচেতা। ও যা বিশ্বাস করে, তা সরাসরি বলতে যেমন পিছপা হয় না, তেমনি ওর প্রতিটি কাজেও থাকে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের ছাপ। যে কারণে সিরাজ যখন শামাকে ভালোবাসার কথা জানায়, শামা লুকোচুরির মধ্যে না গিয়ে সরাসরি সিরাজকে জানিয়ে দেয় সিরাজের জন্য ওর হৃদয়ে ভালোবাসা আছে, একজন খুব প্রিয় বন্ধু হিসেবে, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে চিন্তার বাইরে। এই হচ্ছে শামা। আর এই শামাকেই প্রথমবার দেখেই ভালোবাসার মাতাল হাওয়ায় হারিয়ে যায় নাফিস। নাফিসকে শামারও খারাপ লাগে নি। কিন্তু সম্মতি দেবার আগে শামা চেয়েছিলো, নাফিস যাতে ওর পরিবারকে দেখে, ওর মূলটাকে চিনে। সেই মূল চেনানোর জন্যই আজ সে নাফিসকে সাথে নিয়ে বাসায় আসছিলো। বাসায় এসেই দেখতে পেলো সিরাজ অজ্ঞান হয়ে আছে।

শামা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলো, নাফিস ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে, হাত নেড়ে কী যেনো ডাক্তারকে বোঝাচ্ছে! মনে হচ্ছে সেই ডাক্তার! হেসে ফেললো শামা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো এই ছেলেটাকে সে ‘না’ বলতে পারবে না। একটু পর নাফিস এসে যখন শামাকে বলতে লাগলো, ডাক্তার বলেছে সিরাজের বিপদ কেটে গেছে, ওর আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে অতিরিক্ত এলকোহল সেবনের জন্য ফ্যাটি লিভার দেখা গেছে, আর মারাত্নক কিছু নেই, দুই একদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে, তখন কোনো কিছুই যেনো শামা শুনতে পাচ্ছিলো না। বিহ্ববল নয়নে নাফিসের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলো,

“শুনি আপন বুকের দুরুদুরু
সেখানে এক মত্ত আগ্নতুক,
রক্তকণায় তুলেছে তোলপাড়
সেখানে সুখ, আমার সুখ”।

——————————–

বাসে করে যখন মিলন সেলিনাকে নিয়ে ঢাকার দিকে আসতে লাগলো, চিন্তা করছিলো এই অবস্থায় কীভাবে বেপারী পাড়ার বাড়ির কথাটা সেলিনাকে বলবে। একেতো সেলিনা কখনো এসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে নি, তার উপর হাবিবের ঘটনাতে খুব চুপ হয়ে গেছে। বাসে একসাথে প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেছে, কোনো কথা সেলিনা বলেনি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মাঝে একবার ওর ফুফু ফোন করেছিলো। ডাক্তার না কী বলেছে এক্সিডেন্টের পর মাথায় রক্তপাত হয়েছে, যাকে বলে এপিডুর্যারল হেমাটোমা। স্কয়ার হাসপাতালের অভিজ্ঞ ভারতীয় ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন করেছে, এখন নিউরো আইসিইউ-তে আছে, তবে এখনো জ্ঞান ফিরে নি। ডাক্তার আশা করছেন পনের থেকে বিশ দিনের ভিতরে হাবিব অনেক খানি সুস্থ হয়ে উঠবে। এই কথা গুলো ফুফুর কাছ থেকে শুনে সেলিনা মিলনকে জানিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিলন একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললো, ‘সেলিনা, তোমাদের বেপারী পাড়ায় যে বাড়িটা আছে, সে টা সড়ক সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ভাঙার জন্য দ্বিতীয় এবং শেষ নোটিশ দিয়েছে। ভাঙ্গা বন্ধ করার জন্য এখনই কিছু একটা করা উচিৎ। এই মুহুর্তে হাবিবের এই অবস্থা, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি করা উচিৎ’। সেলিনা পুরো কথাটি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর কোমল অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললো, ‘মিলন ভাইয়া, আপনাকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছি আমি। আপনি আমাদের জন্য অনেক করছেন। খুব কৃ্তজ্ঞ আমি। বেপারী পাড়ার বাড়িটি নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি এটা ফুফাকে বলবো। উনি নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবেন’। সেলিনার কথাগুলো যেনো চাবুক মারার মতো সপাং করে মিলনের পিঠে গিয়ে লাগলো। মিলন খেয়ালই করেনি হাবিবের ফুফা ঢাকার একটি বড়ো ব্যাংকে পরিচালক পদে আছেন। তাঁর পক্ষে আদালত থেকে স্টে-অর্ডার বের করে আনা কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু মিলনকে বিস্মিত করেছে সেলিনার কথা বলার ভঙ্গীটি। মেয়েরা মনে হয় কোনো শক্ত আঘাত পেলেই মানসিকতায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। মিলন আর কোনো কথা বললো না, পুরো যাত্রা পথেই এক অসহনীয় নিরবতা দুই জনকেই ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছিলো, মিলনের যেনো মনে হচ্ছিলো,

“নদীর কিনারে গিয়ে মনে পড়ে নদীর চেয়েও উত্তাল সুগভীর নারীকে
সন্ধের আকাশ কী অকপট, বাতাসে কোনো মিথ্যে নেই,
তখন খুব আস্তে, ফিসফিস করে, প্রায়
নিজেরই কানে-কানে বলি,
একটা মানুষ জন্ম পাওয়া গেল, নেহাৎ অ-জটিল কাটলো না!”

———————————————-

দিপ্ত মাত্র মেডিকেল পাশ করেছে। রাজধানী শহরের একটি নামকরা বেসরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেই সে স্কয়ার হাসপাতালে জয়েন করেছে। ওর বাবা স্কয়ার টয়লেট্রিজের এক বড়ো পদে কর্মরত আছেন, তাই দিপ্তের এই চাকরীটা পেতে খুব একটা কষ্ট হয় নি। এখানে আসার পর দেখলো, অনেকেরই চাকরী হয়েছে লবিংয়ের মাধ্যমে। ওকে দেওয়া হয়েছে নিউরো আইসিইউতে। আইসিইউ-এর ম্যান্যাজমেন্ট সম্পর্কে ওর আসলে তেমন ধারণা নেই। তার উপর আজকেই প্রথম নাইট ডিউটি। দিপ্ত আরেকটি ব্যাপার নিয়ে আজ একটু অস্বস্তিতে আছে। আজ রাতের অনকল ডাক্তার হচ্ছেন সিলভা পান্ডিয়ান স্যার, ইন্ডিয়ান, দিপ্ত এখনো তাঁর সাথে সহজভাবে কথা বলতে পারে না। হয় সে সিলভা পান্ডিয়ানের কথা বুঝে না, নতুবা সিলভা পান্ডিয়ান দিপ্তের কথা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। আজ রাতে আবার এক খারাপ রোগী আছে। বিকেলের দিকে সিলভা পান্ডিয়ান স্যার ইমার্জেন্সী ক্রানিওটমি অপারেশন করেছেন। রোগীর নাম হাবিব। রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রাইভেট কারে চাপা পড়েছিলো। দিপ্ত আইসিইউ-এর এসি রুমে বসে একটা খিস্তি দিয়ে বসলো, ‘শালা, এরা রাস্তাও পার হতে পারে না। আরে বাবা, এক্সিডেন্ট যখন করেছিস, মারা যা, তাহলে আজকে রাতটা ঘুমাতে পারতাম। বেঁচে থেকেতো আমারে বিপদে ফেললি’।

মধ্যরাতে দিপ্তের যখন তন্দ্রামতো হচ্ছিলো, সিস্টার ওকে জানালো হাবিব নামের রোগীটির ব্লাড প্রেশার দ্রুত কমে যাচ্ছে, দুই চোখের মনি অসমান। আইসিইউতে অনভিজ্ঞ দিপ্ত ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুধাবন করতেই কিছুটা সময় নিলো। তারপর যখন ফোনে সিলভা পান্ডিয়ানকে জানালো, সিলভা পান্ডিয়ানের দিপ্তের কথা বুঝতে আরো কিছুটা সময় গেলো। রাত তিনটার সময় যখন সিলভা পান্ডিয়ান দ্বিতীয় বারের মতো হাবিবকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন, তখন সেলিনা আর মিলি দুই জনই একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে ওটির সামনে বসে রইলো।

ফযরের নামাজের সময় অপারেশন শেষ করে ভারতীয় ডাক্তার সিলভা পান্ডিয়ান হাবিবের ফুফাকে বললেন, ‘ব্রেনের প্রেশার বেড়ে যাওয়াতে প্রথমবারের অপারেশনের জায়গায় আবার রক্তপাত হয়। সেই রক্তপাতটা বন্ধ করতেই আবার এই অপারেশন। তবে এবার ব্রেইনের কিছু সুস্থ অংশও নষ্ট হয়েছে। তাই বলা যাচ্ছে না, রোগীর অবস্থা কেমন হবে। খুব সম্ভাবনা আছে অনেকদিন যাবত বিছানায় পড়ে থাকার’। দিপ্ত এইসব কথা শুনে চিন্তা করছিলো কি দরকার এইসব কথা রোগীর লোকদের বলার, ইন্ডিয়ানরা আসলেই কেমন যেনো! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আর দুই ঘন্টা বাকী আছে ওর ডিউটি শেষ হতে। দিপ্তের আরো একটি ব্যাপারে আজ মেজাজ খুব ভাল নেই। আজ থেকেই রোজা শুরু হয়েছে, অথচ সেহেরীর সময় স্যারের সাথে ওটিতে থাকতে হয়েছে, কিছু খাওয়া দাওয়াও করতে পারে নি। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিপ্ত ভাবলো, কী জঘন্য একটা রাত গেলো আজ!

সরল রেখা-বক্র রেখাঃ অষ্টম পর্ব

সরলরেখা-বক্ররেখাঃ নবম পর্ব

সরলরেখা-বক্ররেখাঃ দশম পর্ব

সরলরেখা-বক্ররেখাঃ একাদশ পর্ব

সরলরেখা-বক্ররেখাঃ দ্বাদশ পর্ব

সরলরেখা – বক্ররেখা

(এটি একটি বারোয়ারি গল্প। ‘চতুর্মাত্রিক’ ব্লগে প্রথম পর্বটি লিখেন নাজমুল হুদা ভাই। এই পর্বটি হচ্ছে তৃতীয় পর্ব। সবগুলো পর্বের লিঙ্ক যথাসময়ে আপডেট করা হবে।)

সরলরেখা – বক্ররেখাঃ প্রথম পর্ব

সরলরেখা – বক্ররেখাঃ দ্বিতীয় পর্ব

রুম থেকে বের হয়েই হাসির দমকে ছলকে উঠছে সেলিনা, এতো বড়ো একটা মানুষ এখনো ছোট বাচ্চাদের মতো বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে! মিলনের অপ্রস্তুত ভাবটা সেলিনা খুব উপভোগই করেছে, মিলন ভাবছে সেলিনা বুঝতেই পারেনি।

আজকের সব খাবার সেলিনা নিজ হাতেই রান্না করেছে। সাধারণত বুয়াই সবসময় এই কাজটা করে, কিন্তু আজকে রান্না করতে সেলিনার ভালোই লাগছিলো। ভাইয়া যখন দুয়ে্ক দিন আগে বললো সে ঢাকায় যাবে, বাসায় এসে মিলন থাকবে, শুনে সেলিনা কিছুক্ষন চুপ ছিলো। একবার ভাবলো বলে, একসাথেই দুইজনে ঢাকায় যাবে বা ও একাই বাসাতে থাকতে পারবে। কিন্তু বললো না। ভাইয়া ওর বন্ধুদেরকে, বিশেষ করে সিরাজ ভাই আর মিলন ভাইকে খুব পছন্দ করে। এখন ও ‘না’ বললে ভাইয়া কষ্ট পাবে, ভাববে সেলিনা বোধহয় মিলনকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই শেষ পর্যন্ত সেলিনা রাজি হয়েছে।

সেলিনা খুব ছোট থেকেই সিরাজ ভাইকে দেখে এসেছে, ওদের বাসায় ভাইয়ার সাথে প্রায়ই আসতো। সিরাজ ভাইকে ওর প্রথম দিকে খুব বিরক্ত লাগতো। বাসায় যখন আসতো, সুযোগ পেলেই পিচ্চি সেলিনার ঝুটি বাঁধা চুল ধরে টান দিতো, আর হেসে হেসে বলতো, ‘সেলিনা, সেলিনা, তোমার সাথে খেলিনা, খেলিনা’। কিন্তু ওর যেদিন প্রচন্ড জ্বর হলো, জ্বরের ঘোরে সেলিনা প্রলাপ বকা শুরু করলো, মধ্যরাতে ওর ভাইয়া হতবুদ্ধি হয়ে সিরাজের কাছে ছুটে গেলো। সেদিনের কথা সেলিনার এখনো মনে আছে, ওর ভাইয়া আর সিরাজ ভাই ওকে পাঁজাকোলা করে শহরের আরেকপ্রান্তে ডাক্তার চাচার বাড়িতে নিয়ে, অতরাতে তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সেলিনাকে দেখিয়েছে। ফার্মেসীর ছেলেকে বাড়ি থেকে আনিয়ে দোকান খুলে ঔষুধ কিনেছে। সেদিন সিরাজ ভাই না থাকলে ওর ভাইয়া কিছুই করতো পারতো না। সেই থেকে সিরাজ ভাইয়ের প্রতি সেলিনার একটা প্রবল শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে, যদিও তার সেলিনাকে নিয়ে মজা করার স্বভাবটা এখনো যায় নি। তবে সেলিনা ইদানীং সিরাজ ভাইয়ের উপর একটু বিরক্ত। ও মাঝে মাঝে টের পায়, ভাইয়া বাইরে থেকে কিছু একটা খেয়ে মাঝরাতে বাসায় আসে, কথা বলার সময় জড়িয়ে যায়। ওকে ধরাধরি করে নিয়ে আসে সিরাজ ভাই। একদিন সিরাজ ভাইয়ের কাঁধ হতে ভাইয়াকে ধরতে গিয়ে ও দুইজনের মুখেই একটা বাজে গন্ধ পেয়েছিলো, গন্ধটা পেয়ে ওর খুব বমি আসছিলো।

এইদিক থেকে মিলন ভাই অনেক ভালো। মিলন ভাইয়ের সাথে ওর ভাইয়ার পরিচয় হয় কলেজে। মাঝে মাঝে বাসায় আসতো। খুব কম কথা বলতো, কথা বলতে গেলে মনে হয় লজ্জায় কথা আটকে যেতো। ভাইয়ার কাছ হতে শুনেছে মিলন ভাইয়ের কোনো বোন নেই, তাই বোধহয় মেয়েদের সাথে কথা বলতে একটা জড়তা কাজ করে। সেলিনা সেজন্য খুব একটা সামনেও যেতো না। মিলন ভাই সম্পর্কে খুব একটা ভালোও জানে না। মানুষটা কি কি খেতে পছন্দ করে, কীভাবে থাকতে চায় চিন্তা করতে গিয়ে সেলিনা একটু বিপদেই পড়ে গিয়েছিলো। পরে সবকিছু নিজের পছন্দ মতো করেছে। থাকার রুমটা পছন্দ হলো কী না সেটাও এখন পর্যন্ত জানা হলো না।

এসব কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে মিলন খাবার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, সেলিনা লক্ষ্যই করেনি।

– আরে, এতো এলাহী ব্যাপার! আমাকে কী তোমার রাক্ষস মনে হচ্ছে? এতো কিছু খাবো কীভাবে?
– যতটুকু খেতে পারবেন, ততটুকুই খাবেন। কোনো সমস্যা নেই।

চেয়ার টেনে মিলন খেতে বসলো। উল্টোদিকে সেলিনাও খেতে বসলো। বুয়া খাবার বেড়ে দিচ্ছে। সেলিনার দিকে মিলন তাকিয়ে দেখলো ও একটা হালকা নীল রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়েছে, দীঘল কালো চুল ছেড়ে দেওয়া আছে। কপালে একটা নীল রঙের ছোট টিপও দিয়েছে। খুব সুন্দর লাগছে সেলিনাকে। খেতে খেতেই মিলন সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি হতে চাও, সেলিনা?’

মিলনের প্রশ্ন শুনে সেলিনা হেসে দিলো।

– ভাইয়া, আমি এখনো এস এস সি পরীক্ষা দেইনি, আগামী বছর দিবো। তাই সেভাবে ঠিক করিনি কি করবো। শুধু এটুকু বলতে পারি আমি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখি। তাতে আকাশটাকে ছুঁতে না পারলেও কাছাকাছি তো যেতে পারবো। আমার কথা বাদ দিন। আপনার কি ইচ্ছে সেটা বলুন।

সেলিনার উত্তর শুনে মিলন খুব মুগ্ধ হলো, এমনিতেই সেলিনার কথা শুনতে ওর খুব ভালো লাগে, ও কথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে বলতে পারে। সঙ্গো্পনে মিলন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, ওর যদি এরকম একটা ছোট বোন থাকতো!

– আমি ডাক্তার হতে চাই, মানুষের সেবা করতে চাই। অসহায়, দরিদ্র মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই।
– শুধু মানুষের সেবা করতে চান? আজকাল ডাক্তাররা তো মানুষের সেবার চেয়ে নিজের সেবাটাই বেশি করে। একেকজন ডাক্তার যেনো একেকজন কসাই, শুধু টাকা চেনে। ডাক্তার হবার আগে বলে মানবসেবা করতে চাই, ডাক্তার হবার পরে বলে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’।
– পুরোপুরি ভুল তুমি বলো নি। তবে অবস্থার পরিবর্তন আস্তে আস্তে হচ্ছে। সময় লাগবে, কিন্তু হবে। ভালো কথা, খাবারটা তোমার মতোই খুব সুন্দর হয়েছে। কে রান্না করেছে?

মিলনের কথায় লজ্জা পেয়ে গেলো সেলিনা, ওর ফর্সা গালটা রক্তিম হয়ে উঠলো। কোনো রকমে বলতে পারলো, ‘আমি’। পরমুহুর্তেই বলে উঠলো, ‘আপনিও তো চমৎকার করে কথা বলেন! আর আমি ভেবেছি, আপনি বোধহয় কথা বলাই জানেন না’, বলেই সেলিনা হেসে উঠলো। এবার মিলনের লজ্জা পাবার পালা। ও একটু চমকেই গেলো, বুঝতে পারছে না আজ কীভাবে সে এতো কথা বলতে পারছে! খাওয়া শেষ করে রুমে যাবার আগে মিলন সেলিনাকে জানালো সে আগামীকাল সকালে একটা জরুরী কাজে ব্যস্ত থাকবে, দুপুরে খেতে আসতে পারবে না, একেবারে বিকেলে আসবে।

রাতে ঘুমাতে গিয়ে মিলনের বার বার সেলিনার আকাশ ছোঁয়ার কথাটা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে আকাশ নিয়ে নির্মলেন্দু গুণের লেখা কবিতাটি-

“আমার সমস্ত ভাবনা যখন তোমাকে ছোঁয়,
আমার সমস্ত উপলব্ধি যখন তোমার
আত্মাকে স্পর্শ করে, আমার সমস্ত বোধ
যখন তোমার বোধিতে নিমজ্জিত হয়,
তখন আমার প্রাণের গভীর থেকে
স্বতঃস্ফূর্ত মোহন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়
একটি অত্যন্ত সহজ শব্দ…”আকাশ” ।

আমি শব্দটিকে ক্রমাগত উচ্চারণ করি ।
জানি না কেন এ শব্দটিই শুধু
এত বারবার ঘুরে ঘুরে আসে ।
জানি না কী পেয়েছে সে আমার ভিতরে?
আমি লক্ষ্য করেছি, ‘আকাশ’ শব্দটি
উচ্চারিত হওয়ার পরে আমার ভিতরে
আর কোন কষ্টই অবশিষ্ট থাকে না ।
যেন যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেটের মতো
আমার বুকের ভিতরে গেঁথে ছিল
এই যন্ত্রণাক্ত আকাশ শব্দটি ।

তোমার আমার মাঝে আছে এরকম
অনেক আকাশ । – আমি
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো মুগ্ধমূর্খচোখে
কেবল তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে” ।

————————————-

ঢাকার ধানমন্ডিতে লেকের পাশেই হাবিবের ফুফুর বাসা। খুব ফুরফুরে মন নিয়ে হাবিব ঢাকায় এসেছে, অনেকদিন পর। সাত দিনে ঢাকাকে সে আবার আবিস্কার করবে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে ফুফুর বাসায় ঢুকার সময় ওর মিলির চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেই দুই বছর আগে দেখেছে ওকে। তখনই খুব সুন্দর লেগেছিলো, এখনকার কথা চিন্তাই করতে চাচ্ছে না। হাবিব কী মিলিকে ভালোবাসে? জানে না, একটু একটু বোধহয় ভালোবাসে, তাও নিজের কাছে স্বীকার করতে লজ্জা পায়। মিলি কী হাবিবকে ভালোবাসে? হাবিব জানে, মিলি ওকে খুব ভালোবাসে। গতবার একটা চিঠি সবার অজান্তে হাবিবের হাতে তুলে দিয়েছিলো চলে আসবার সময়। বাড়িতে এসে চিঠিতে দেখে রবীন্দ্রনাথের ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ গানটিই শুধু লেখা। তাতেই যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলো হাবিব। ব্যাপারটা নিয়ে ও তখন সিরাজের সাথে কথাও বলেছিলো, সিরাজ একটু আদি রসিকতা করেছিলো। হাবিব সিরাজের উপর তখন খুব বিরক্ত হয়েছিলো। পরে যখন মিলনকে বলেছিলো, মিলন বলেছিলো চিঠি না লিখে একেবারে সামনা সামনি কথা বলতে। আজ মিলির সাথে সামনা সামনি দেখা হবে। হাবিবের বুক কী একটু ধড় ফড় করছে?

কলিং বেল টেপার পর কাজের বুয়া দরজা খুলে দিলো। ফুফুতো হাবিবকে দেখে অনেক খুশি! জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘কতদিন পর এলি!’ হাবিব ফুফুর আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু মিলিকে দেখতে পাচ্ছে না। সে জিজ্ঞেসই করে ফেললো, ‘ফুফু, মিলি কৈ? দেখছি না যে!’ ‘রুমে আছে, ওকে ডাক দিচ্ছি’, বলেই ফুফু চলে গেলেন মিলিকে ডাকতে।

ফুফু মিলিকে ডাকতে যেতেই হাবিব ড্র্য়ংরুমের ওয়ালমেটগুলো দেখতে লাগলো। খুব সুন্দর ছবিগুলো। চিন্তা করছে, এবার বাড়িতে যাবার সময় সেও দুয়েকটা কিনে নিয়ে যাবে, সেলিনা খুব খুশি হবে। বোনটার খুব রুম সাজানোর বাতিক আছে। সেলিনার কথা মনে আসতেই, ওর মনে হলো বাড়িতে কিছুক্ষন পরে ফোন দিবে। নিশ্চয়ই ভালো থাকবে, মিলন আছে যেখানে, কোনো সমস্যা হবে না।

– অবশেষে এলেন! আমি তো ভাবলাম, আপনাকে আর কাছেই পাবো না।

কখন যে মিলি চলে এসেছে টেরই পায়নি হাবিব। ঘুরে মিলিকে দেখে খুব ভালো লাগলো ওর। আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। হেসে বললো,

“কাছে যতটুকু পেরেছি আসতে, জেনো
দূরে যেতে আমি তারো চেয়ে বেশী পারি।
ভালোবাসা আমি যতটা নিয়েছি লুফে
তারো চেয়ে পারি গোগ্রাসে নিতে ভালোবাসা হীনতাও”।

———————————————–

বিকেলের দিকে মিলন কাজ শেষ করে হাবিবদের বাসায় আসলো। দরজা খুলে দিলো বুয়া। সেলিনা কোথায় জিজ্ঞেস করতে বললো ওর রুমে আছে। কিছুটা ইতস্তত করে মিলন সেলিনার রুমের দরজায় টোকা দিলো। ভিতর থেকে সেলিনা জানতে চাইলো, ‘কে?’ মিলন ভেজানো দরজাটা আলতো করে খুলে ভিতরে তাকিয়ে দেখলো সেলিনা বিছানাতে আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে, নামটা দেখতে পেলো ‘সাতকাহন’। দরজায় দাঁড়িয়েই মিলন বললো,

“কাছে যাওয়া বড্ড বেশি হবে
এই এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো,
তোমার ঘরে থমকে আছে দুপুর
বারান্দাতে বিকেল পড়ে এলো”।

চমকে উঠলো সেলিনা, ‘আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি এখন এই অংশটুকুই পড়ছি’। হেসে কিছুটা রহস্য করে মিলন বললো, ‘আমি যাদু জানি!’ মিলনের কথা বলার ধরনে হেসে ফেললো সেলিনা। বললো, ‘আচ্ছা চলুন, বাইরে বাগানে যাই’।

ওরা যখন বাগানে আসলো, মিলন দেখতে পেলো রাস্তা থেকে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে সিরাজ!

——————————————————-

সরলরেখা – বক্ররেখাঃ চতুর্থ পর্ব

সরলরেখা-বক্ররেখা : পঞ্চম পর্ব

সরলরেখা – বক্ররেখাঃ ষষ্ঠ পর্ব

সরলরেখা – বক্ররেখাঃ সপ্তম পর্ব