দেবতাদের পুনরাগমণ

“ত্রয়োদশ যুগের শেষে, যখন ইটজা ক্ষমতার শীর্ষে থাকবে, সে সাথে টানকাহ নামের শহরটিও, তখন ইশ্বরের সংকেতও উচ্চতায় উঠে আসবে এবং ‘ক্রস’, যার দ্বারা বিশ্ব আলোকিত হয়েছিল, তা প্রকাশিত হবে। ভবিষ্যতের সময়ে পুরুষদের ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য দেখা দিবে, যখন এই সংকেত আসবে… তোমরা (সে সময়ে) পূর্ব থেকে আসা দাড়িওয়ালা অতিথিদের গ্রহণ করো, যারা ইশ্বরের সংকেত নিয়ে আসবেন, যারা আমাদের কাছে দয়া ও করুণা নিয়ে আসবেন। আমাদের জীবনের সময় আসছে…”

মায়াদের, বিশেষত ইউকাটান মায়াদের ধর্মীয় গ্রন্থ ‘চিলাম বালাম’এ এভাবেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এই ভবিষ্যদ্বাণী। ফলে মায়ারা পূর্ব দিক থেকে আসা দাড়িওয়ালা স্প্যানিশ অতিথিদের গ্রহণ করেছিলেন!

কোয়াটজালকোয়াটল টলটেক জাতিদের সৃষ্টিকর্তা দেবতা, তিনি ছিলেন সকাল ও সন্ধ্যার তারা। অনেক অনেক পরে যখন অ্যাজটেকরা মেক্সিকোতে তাদের প্রভাব বিস্তার করেন, তখন তারাও কোয়াটজালকোয়াটলকে তাদের দেবতা হিসাবে গ্রহণ করেন। পুরাণে ছিল, কোয়াটজালকোয়াটল সাপে পরিপূর্ণ ভেলাতে করে পূর্ব দিকে সাগরে হারিয়ে গিয়েছেন। তিনি আবার ফিরে আসবেন- টলটেকদের কিংবদন্তী রাজা টোপিল্টজিনের রূপে। তাই খ্রিষ্টাব্দ ১৫১৯ সালে পূর্ব দিক থেকে যখন স্প্যানিশ হারনান কর্টেস এসেছিলেন, অ্যাজটেক রাজা দ্বিতীয় মক্টেজুমা তাঁকে কোয়াটজালকোয়াটল হিসাবে বরণ করে নিয়েছিলেন। ফলে, অ্যাজটেক সাম্রাজ্য স্প্যানিশদের পদানত হয়েছিল!   

ইনকা রাজা হুয়ানা কাপাক যখন মৃত্যু শয্যায় ছিলেন, তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী হুয়াসকারকে প্রাচীন ইনকা পুরাণের কথা স্মরণ করিয়ে বলেছিলেন, “ত্রয়োদশতম ইনকা রাজার সময়ে, যখন তোমরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়বে, তখন পূর্ব দিক থেকে আমাদের সূর্য দেবতা আসবেন। আমি তোমাকে আদেশ দিচ্ছি, তুমি তাদেরকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে গ্রহণ করবে, তাদের বাধ্যগত থাকবে। তারা অবশ্যই তোমার চেয়ে অনেক উন্নত প্রকৃতির হবে, তারা ইনকাদের শাসন করবে!”  

হুয়াসকার এবং তাঁর ভাই আতাহুয়ালপা যখন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছিলেন, স্প্যানিশরা এসেছিলেন পূর্ব দিক থেকে! ইনকাদের সূর্য দেবতা ফিরে এসেছেন! ফলে ফ্রান্সিসকো পিজারোর পক্ষে খুব একটা অসম্ভব হয়ে উঠেনি বিশাল ইনকা সাম্রাজ্যকে পরাভূত করতে!

মায়া, অ্যাজটেক এবং ইনকা- মেসো-আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার তিনটি মহান সভ্যতা। এই তিনটি সভ্যতারই সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটেছিল স্প্যানিশদের কাছে। বলা হয়ে থাকে, এত সহজে স্প্যানিশরা এদেরকে জয় করতে পেরেছিলেন- তিন সভ্যতার এই তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য- যেখানে প্রতিটিতেই বলা হয়েছে- দেবতা পুনরাগমণ ঘটবে! তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন- কর্টেস কিংবা পিজারো- সেই দেবতা, যার পুনরাগমণ ঘটেছে তাঁদেরকে শান্তি এনে দেবার জন্য।

এই তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যাসত্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, এমনকি মাঝামাঝি সময়েও ঐতিহাসিকরা এই পুরাণগুলোর সত্যতা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু এখন ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন, মূল কোনো গ্রন্থে এগুলোর অস্তিত্ব ছিল না। স্প্যানিশরাই এই পুরাণগুলোকে নিজেদের সুবিধামত পরিবর্তন করেছেন।

এই পুরাণ বা ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আসলেই ছিল, না কি এগুলো স্প্যানিশদের হাতে পরিবর্তিত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা এই গ্রন্থের নির্দিষ্ট অংশে বিস্তারিত আলোচনা করব; তবে এটুকু স্বীকার করা কঠিন নয় যে, শুধু এসব ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য নয়, আরো অনেক কারণেই এই তিনটি সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের প্রবল আগ্রহ আছে। আমাদের আগ্রহ আছে মায়া পিরামিড নিয়ে, মায়া হায়ারোগ্লিফ নিয়ে। আমরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম খ্রিষ্টাব্দ ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর- এই বুঝি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল! আমাদের আগ্রহ আছে মায়া ক্যালেন্ডার নিয়েও। আমরা প্রবল ইচ্ছা আছে জানার অ্যাজটেকদের কী পরিমাণ সোনা-রূপা ছিল? সত্যিই কি তারা সোনাকে হেলাফেলার মত এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতেন? আমাদের ভীষণ তৃষ্ণা আছে জানার – এল ডোরাডো কোথায় আছে?

এই জানার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকেই এক মলাটের ভিতরে তিনটি বিশাল সভ্যতাকেই নিয়ে আসার এক দুর্দান্ত দু:সাহসিক প্রচেষ্টা হচ্ছে এই গ্রন্থটি।

মায়া, অ্যাজটেক এবং ইনকা সভ্যতার বেশ কিছু সাধারণ উপাদান আছে, যেমন চাষ করা, সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা, অনেক দেবতাদের উপাসনা করা। প্রকৃতপক্ষে এই তিনটি সভ্যতা যেসব ভূ-খন্ডে অবস্থিত ছিল, সেসব ভূ-খন্ডের বৈচিত্রের মতই সভ্যতাগুলোও বৈচিত্রময় ছিল। মায়ারা বিকাশ করেছিল গণিত ব্যবস্থাকে, অ্যাজটেকরা গড়ে তুলেছিল বড় এবং জনবসতিপূর্ণ শহর টেনোচটিটলান এবং ইনকারা আন্দিজ পর্বতমালার উঁচুতে অবস্থিত তাদের সাম্রাজ্যকে একত্রিত করার জন্য রাস্তা এবং সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োগ করেছিল প্রকৌশলী বিদ্যার। এসব কিছু নিয়েই

“মিথলজির আদি অন্ত- ওলমেক থেকে ইনকা”

Leave a comment