বইমেলা ডায়েরীঃ ১০/০২/২০১২ ও ১১/০২/২০১২ (মোড়ক উন্মোচন মিস!)

১০ তারিখ সকাল থেকেই আমি প্রস্তুত ঢাকায় আসার জন্য। আবদুর রাজ্জাক শিপন ভাইয়ার “সোনামুখী সুঁইয়ে রুপোলী সুতো” র মোড়ক উন্মোচন হবে বিকেল পাঁচটায় আর ১১ তারিখে হবে “চতুর্মাত্রিক” ব্লগ সংকলনের। তাই ঢাকায় আসার জন্য এতো অস্থির হয়ে ছিলাম।

বিধাতা অলক্ষ্যে মুচকি হাসছিলেন বোধহয়। হাসপাতাল থেকে বের হবার সময়ই এক রোগী আসলো – ২৮ বছরের সদ্য বিবাহিত যুবক। বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় রক্তক্ষরণ। আটকে গেলাম আমি, আর ভাবতে লাগলাম কেনো যে ডাক্তার হলাম! আবার গর্বও হতে লাগলো, ডাক্তার বলেইতো রোগীকে অন্য কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।

১০ তারিখ সকালটা শুরু হয়েছিলো অবশ্য খুব ভালো একটা সুখবর দিয়ে। অন্যপ্রকাশ থেকে কমল ভাইয়া ফোন করে বললো, “সরলরেখা – বক্ররেখা” শেষ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে হুমায়ূন আহমেদের বই নিয়ে প্রেস ব্যস্ত থাকায় এখনই ২য় মুদ্রণ বের করতে পারছে না। আমাদের কাছে যে কপিগুলো আছে সেখান থেকে কিছু বই যেনো ধার দেই! দিয়ে দিলাম কিছু বই ধার, আশা করছি ফেব্রুয়ারির ৩য় সপ্তাহে অন্যপ্রকাশ সুযোগ পাবে ২য় মুদ্রণের।

হাসপাতাল থেকে শেষ পর্যন্ত ২ টার সময় বের হলাম। সয়দাবাদ থেকে তিনটায় ট্রেনে উঠলাম। শুনতে পেলাম এই ট্রেনেই আইনমন্ত্রী ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে যাবে, তাই ট্রেন কোনো জায়গাতেই খুব একটা দেরী করছিলো না। তবুও পাঁচটার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছার আশা ছেড়েই দিলাম। এমন সময় আবদুল করিম ফোন করে বললো মোড়ক উন্মোচন হবে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। আমি এয়ারপোর্টে এলাম ছয়টায়, সেখান থেকে আমার বাসায় যেতে যেতে সাতটা, বাসা থেকে মেলায় সাড়ে সাতটায়। গিয়ে দেখি ভাঙ্গা হাট!

নাজমুল ভাইয়া, সাহাদাত উদরাজী ভাইয়া আর ঈশান ভাইয়ার সাথে দেখা হলো। রকমারি.কমের সামনে করিমের সাথেও দেখা হলো। সেখান থেকে চতুর্মাত্রিক ব্লগ সংকলন একটা কিনলাম। আমি অবশ্য ভেবেছিলাম, যেহেতু আমার একটা লেখা সংকলনে প্রকাশ পেয়েছে, বোধহয় এক কপি ফ্রি পাবো!

কিছুক্ষন সেখানে আড্ডা দিয়ে চলে গেলাম অন্যপ্রকাশ স্টলে। সেখান থেকে লিটল ম্যাগ চত্বরে। দেখা হলো শব্দনীড়ের জাকির ভাইয়ার (ভালোবাসার দেয়াল) সাথে। তিনটি বই কিনলাম, ব্লগারস ফোরাম থেকে প্রকাশিত নীড় গল্পগুচ্ছ, নির্বাচিত বাংলা গদ্য কবিতা আর শব্দতরীর সর্বশেষ সংখ্যা। জাকির ভাইয়া আমাকে নিয়ে আবার অন্যপ্রকাশে গিয়ে সরলরেখা – বক্ররেখা কিনে স্টলের সামনে আমার অটোগ্রাফ চেয়ে বসলেন। আমি খুবই লাজুক ভঙ্গিতে আমার নামটা লিখে দিলাম!

আজ ১১ তারিখেও আমি দেরী করে ফেললাম। মেলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ছয়টা। ততক্ষনে “চতুর্মাত্রিক” ব্লগ সংকলনের মোড়ক উন্মোচন শেষ। কিন্তু দেখা হলো অনেকের সাথে। আকাশগঙ্গাকেই প্রথম দেখি, তারপর চোখে পড়ে ফয়সাল রাব্বিকে। পরিচিত হই ফ্রয়েডের অবচেতনার সাথে, ভেবেছিলাম বয়স্ক কেউ, দেখি নওজোয়ান! মেঘ অদিতি আপুর সামনে একুয়া রেজিয়াকে জিজ্ঞেস করছি মেঘ অদিতি আপু কোথায়! চা এবং টা খেতে গিয়ে পরিচয় হলো সাদা কালো এবং ধুসর (সুস্মিতা রেজা খান) এবং ত্রেয়া আপুর সাথে। সাকাধুর কাছ থেকে তার “পেজগি” নিলাম বিশেষ কমিশনে! কখন যে বিলাইদা ওরফে শাওন ভাইয়া এসে হাজির খেয়ালই করিনি!

মেলায় আবার ঢুকে আহমাদ আব্দুল হালিম ভাইকে দেখলাম অনেকগুলো বই হাতে নিয়ে ঘুরছে। নেওয়া হলো “ইরিডেনাস”, মেঘ অদিতি আপুর “মেঘ ডুমুরের ফুল” অটোগ্রাফসহ। অনেকক্ষন ধরে কথা হলো অনীক আন্দালিব আর ঝড়কন্যার সাথে। তারপর কে যে কোথায় একে একে চলে গেলো!

হাটতে হাঁটতে জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশনের সামনে রেজওয়ান তানিম ভাই , লিখন ভাই আর বাবুল হোসাইন ভাইয়ার সাথে দেখা, আবারো আড্ডা। আড্ডা শেষে শিপন ভাইয়ার বইটা কিনতে গিয়ে আবারো ঈশান ভাইয়া আর নাজমুল ভাইয়াকে পেয়ে গেলাম।

শুদ্ধস্বর থেকে “সোনামুখী সুঁইয়ে রুপোলী সুতো” কিনেই আমরা মেলা থেকে বের হয়ে এলাম। শেষ হলো আমার দুই দিনের মেলা ভ্রমন। বইমেলায় আবারো আসতে পারবো আশা করি ১৭ তারিখের পর, ততক্ষণ পর্যন্ত খোদা হাফেজ।

বইমেলা ডায়েরীঃ ০৪/০২/২০১২ (সময় টিভির সাথে আলাপন)

প্রতিবছর একবার, খুব বেশি হলে দুইবার একুশের বইমেলায় যাই। আর এবার বইমেলা শুরু হবার আগের দিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রতিদিন গিয়েছি। মনের টানে, প্রাণের টানে, সরলরেখা – বক্ররেখার টানে।

তিন তারিখ রাতেই অন্যপ্রকাশের কমল ভাইয়া আমাকে ফোন করে বলেছিলো চার তারিখ বিকালে সময় টিভি সরলরেখা – বক্ররেখার লেখক-লেখিকাদের একটি সাক্ষাতকার নিতে চাচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে ফয়সাল আর মানিক চট্টগ্রাম আর সিরাজগঞ্জে পৌঁছে গেছে, নাজমুল ভাইয়া খুলনায় নিজের বাসায় গিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছেন আর জুলিয়ান ভাই ঢাকার বাইরে চলে গেছেন। তাই শুধুমাত্র পলাশ, উদরাজী ভাইয়া আর পাপতাড়ুয়া সোহেলকে খবর দিতে পারলাম, এমনকি অপাংক্তেয় আপুকেও জানাতে পারি নি।

আজ মেলা প্রাঙ্গনে গিয়েছিলাম সাড়ে চারটার দিকে, ইতোমধ্যে অন্যপ্রকাশ থেকে দুইবার ফোন দিয়ে জানালো সময় টিভি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি মেলায় গিয়ে দেখি, তখনো কেউ আসেনি। পলাশকে ফোন দিলাম, মাত্র দিবানিদ্রা থেকে উঠলো। উদরাজী ভাইয়া তখনো অফিস থেকে বের হোন নি, আমাকে জিজ্ঞেস করলো তাঁর আসার প্রয়োজন আছে কি না! আর সোহেল সেই সময় বনানীর যানজটে! আমি সময় টিভির জৈষ্ঠ্য প্রযোজক কমল সিদ্দিক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্টের এক হাসি দিলাম, উনি বললেন আরো আধা ঘন্টা অপেক্ষা করা যেতে পারে।
কিছুক্ষণ পর পলাশের চেহারা দেখা গেলো। আরো বিশ মিনিট অপেক্ষার পর উদরাজী ভাইয়াকে হেলে দুলে আসতে দেখা গেলো, কিন্তু সোহেলের কোন দেখা নেই! অপেক্ষা করতে করতে আমরা যখন সবাই ক্লান্ত, ঠিক হলো সোহেলের কপালে নেই, কী আর করা!

লেখককুঞ্জের সামনে আমাদের সাথে আলাপন শুরু হলো। উদরাজী ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করা হলো সরলরেখার বক্ররেখার শুরু কিভাবে হলো। পলাশ এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে বললো। আর আমাকে বলতে হলো নতুন লেখক হিসেবে বই বের করতে কি কি সমস্যা পোহাতে হয়েছে এবং এর প্রতিকারের উপায় কি। আমাদের আলাপন যখন শেষ, তখন তাকিয়ে দেখি সোহেল এসে গেছে। ততক্ষণে ক্যামেরা অফ! বেচারা সোহেল!

মজার ব্যাপার ঘটলো এরপরে। আমাদের সাক্ষাতকার দেওয়া দেখে লেখককুঞ্জ থেকে এক লেখক বের হয়ে কমল সিদ্দিক ভাইয়ের হাতে তার লেখা বইয়ের একটি কপি দিয়ে তার একটি সাক্ষাতকার নিতে বললো। খুব মজা লাগছিলো টিভি ক্রুদের বিব্রতকর অবস্থা দেখে! লেখক বেচারা শেষ পর্যন্ত সাক্ষাতকার দিতেই পারলো না!

এরপর বাইরে গিয়ে চা খেতে খেতে গীতিকার শেখ রানা ভাইয়ার (ব্লগার নস্টালজিক) সাথে দেখা হলো। বেশ কিছুক্ষণ তার সাথে আড্ডা মেরে মেলায় ঢুকে প্রথমেই গেলাম জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশনে। সেখানে ব্লগার রেজওয়ান তানিমকে পেয়ে গেলাম, নেওয়া হলো তার ‘মৌনমুখর বেলায়’ বইটি। সেখানে আরো দেখা হলো ব্লগার ফালতু (সীমান্ত পথিক) এবং ফেরদৌস হাসানের সাথে। লিটলম্যাগ চত্বরে হলো অসাধারণ আড্ডা।

কিছুক্ষণ পর তাদের কাছ হতে বিদায় নিয়ে একা একা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে আমার নাম ধরে কেউ একজন ডাক দেওয়াতে সম্বিত ফিরে পেলাম। তাকিয়ে দেখি আমি জাগৃতি প্রকাশনীর সামনে দাঁড়িয়ে, আমাকে ভিতর থেকে ডাকছে জলি আপু, প্রকাশকের স্ত্রী, আমাদের মেডিকেলের বড়ো আপু। কথা বলতে বলতে চিন্তা করছিলাম এখান থেকে কোন বই কেনা যায়। হঠাৎই চোখের সামনে দেখতে পেলাম আব্দুর রাজ্জাক শিপন ভাইয়ার গতবছরের উপন্যাস ‘চন্দ্রাবতীর চোখে কাজল রং’, নিয়ে নিতে ভুল হলো না।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে আটটা বেজে গেছে। আমার সাথে পাপতাড়ুয়ার যাওয়ার কথা, ওকে ফোন দিতে গিয়ে দেখি মোবাইলের চার্জ শেষ, কিছুক্ষণ মেলার এ প্রান্তে ও প্রান্তে ওকে খুঁজে বেড়ালাম, কিন্তু পেলাম না।

বিশাল এক দিন গেলো আজ। বিদায় নেবার আগে জানিয়ে যাচ্ছি সময় টিভিতে আমাদের সাক্ষাতকার প্রচারিত হবে বুধবার (০৮/০২/২০১২) রাত সাড়ে আটটায় এবং পুনর্প্রচার করবে বৃহস্পতিবার (০৯/০২/২০১২) দুপুর সাড়ে বারোটায়। সবাইকে দেখার আমন্ত্রণ রইলো।

সরলরেখা – বক্ররেখাঃ মলাটের আড়ালে

একটি গল্প। অসমাপ্ত গল্প। সরলরেখা – বক্ররেখা।

২০১১ সালের ১৯ আগস্ট ‘চতুর্মাত্রিক’ ব্লগের শ্রদ্ধাভাজন ব্লগার নাজমুল হুদা ভাইয়া একটি গল্প লিখলেন, তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর এক বন্ধুর ছোট বোনকে নিয়ে, সরল রখা – বক্ররেখা। গল্পটি তিনি শেষ করলেন না, আবার ধারাবাহিকভাবে লিখতেও চাইলেন না। গল্পের শেষে তাঁর ফুটনোটে লেখা ছিলো, ‘এটা কোন ধারাবাহিক নয়। সেলিনা, হাবিব, সিরাজ, মিলন যদি আবার কখনো আসে, তা’হলে পরের কাহিনী তাদের কাছ থেকে জেনে আপনাদের জানাবার ইচ্ছা থাকলো!’ কিন্তু তাঁর এই ফুটনোট অন্য ব্লগাররা মানতে চাইলেন না! এদের মধ্যে আকাশগঙ্গা নামে খ্যাত মিজানুর রহমান পলাশ তো এই লেখাকে বারোয়ারী রূপ দেবার জন্য নাজমুল হুদা ভাইয়ার কাছ হতে রীতিমতো অনুমতি আদায় করে নিলেন। শুরু হলো এমন একটি বারোয়ারী লেখা, যার সাথে জড়িয়ে গেলো এর লেখকদের ব্যক্তিগত আবেগ, আনন্দ, কষ্ট, সবকিছু।

ডাক্তারের রোজনামচা (ডাঃ এস এম নিয়াজ মাওলা) লিখিত তৃতীয় পর্ব শেষে আকাশগঙ্গা একটি মন্তব্য করেন, ‘এইটা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখে বইমেলায় ছাপিয়ে দিতে পারলে বেশ হয়। এক বই কিনে অনেক লেখকের লেখা পড়া।’ এভাবেই শুরু হলো এক আকাশছোঁয়া স্বপ্নের, যে স্বপ্নের সারথী আমরা সবাই।

এই বারোয়ারী উপন্যাসের সবচেয়ে মজার দিকটি হচ্ছে, এটি পরিকল্পনা করে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে হঠাৎ করে। কোনো পর্ব লেখার জন্য কাউকে আগে থেকে বলা হয়নি, পর্ব রচয়িতারা নিজেদের আগ্রহে, নিজেদের আনন্দেই, স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছেন। প্রত্যেক রচয়িতাই তাদের পর্ব লেখার সময় সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন, তাদের কলমকে ইচ্ছেমতো চলতে দেয়া হয়েছে। আরেকটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বারোয়ারী উপন্যাসটি বারো জনেরই লেখা- The Dazzling Twelve.

The Dazzling Twelve:

১. নাজমুল হুদা – নিজের চাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, “ফিরে দাও সে অরণ্য, লও এ নগর, ফিরে পেতে চাই তারুণ্য–যে চাওয়া কখনও পূরণ হবার নয়।” বর্তমানে তিনি খুলনায় থাকেন। ঢাকায় থাকতে হয় বেশিরভাগ সময়। গোঁড়ামি ছাড়া আর সবকিছুই তাঁর পছন্দ। তাঁর একটি প্রিয় উক্তি হচ্ছে, ‘প্রকৃতি প্রার্থনার বশ নয়। প্রকৃতি প্রার্থনার বশ হলে পৃথিবীর চেহারায় বদলে যেত । পৃথিবীর জন্য প্রার্থনাতো কম করা হয় নি।’ তিনি এই উপন্যাসটির প্রথম পর্ব লেখেন।

২. আকাশগঙ্গা (মিজানুর রহমান পলাশ)- তাঁর নিজের ভাষায়, “আমি মিজানুর রহমান পলাশ। জন্ম শরীয়তপুর সদরে, এখন পড়ালেখা করছি বুয়েটের ইলেক্ট্রিকাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়রিং এর শেষ বর্ষে। ছোটবেলায় রুলটানা হাতের লেখার খাতায় কবিতা লিখে শুরু হয়েছে আমার লেখালেখির জগত। সবসময় আমার লেখালেখির প্রেরনা ছিলেন আমার মা জাহানারা বেগম এবং বাবা মুন্সী ফজলুল হক। স্বপ্ন দেখি সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত নতুন এক বাংলাদেশের যেখানে শীতের রাতে কাউকে রাস্তার পাশে বসে শীতে কাপতে হবেনা, ক্ষুধার জ্বালায় কাউকে গলায় ফাঁস দিতে হবেনা, কিংবা বখাটের এসিডে ঝলসে যাবেনা আমার বোনদের মুখ।” তিনি এই উপন্যাসটির দ্বিতীয়, অষ্টম এবং দ্বাবিংশ থেকে শেষ পর্ব পর্যন্ত লেখেন।

৩. ডাক্তারের রোজনামচা (এস এম নিয়াজ মাওলা)- পেশায় ডাক্তার। ঢাকা শাহীন স্কুল এবং ঢাকা কলেজ জীবনে কিছু কিছু লিখতেন, কিন্তু মেডিকেলে এসে ছুরি-কাচি ধরে সাহিত্যের সব কিছুই ভুলে বসে আছেন। ইদানীং রোগী দেখার ফাঁকে ব্লগে লেখা লিখছেন, বন্ধুদের এবং ডাক্তার সহধর্মিনীর উৎসাহ পাচ্ছেন। প্রফেশনাল জীবনে এই মুহূর্তে সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের নিউরোসার্জারী বিভাগে কর্মরত আছেন। ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়া। তিনি এই উপন্যাসটির তৃতীয়, সপ্তম এবং সপ্তদশ পর্ব লেখেন।

৪. জুলিয়ান সিদ্দিকী- নিজের সম্পর্কে তাঁর মনোভাব হচ্ছে, “জগতের সব কাজই আমি পারি না। অনেক কাজে অলস হলেও লিখতে কখনও ক্লান্তি বোধ করি না। এতে করে আমার সময়গুলো ভালো কাটে।” তিনি এই উপন্যাসটির চতুর্থ ও ষষ্ঠদশ পর্ব লেখেন।

৫. সাহাদাত উদরাজী- নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, “নিজের সম্পর্কে নিজে কি লিখব! কি বলবো! গুণধর পত্নীই শুধু বলতে পারে তার স্বামী কি জিনিস! তবে পত্নীরা যা বলে আমি মনে করি – স্বামীরা তার উল্টাই হয়! কনফিউশান! —– আমি নিজেই!!” তিনি এই উপন্যাসটির পঞ্চম পর্ব লেখেন।

৬. শব্দপুঞ্জ ( ফয়সল কাদের চৌধুরী) — তিনিও পেশায় ডাক্তার। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এম এস (ইউরোলজী) কোর্সে অধ্যয়নরত। তিনি এই উপন্যাসটির ষষ্ঠ ও ত্রয়োদশ পর্ব লেখেন।

৭. পাপতাড়ুয়া (সোহেল মাহমুদ)– ব্যক্তিগত জীবনে যন্ত্রপ্রকৌশলী – কিন্তু তিনি আনন্দ পান মানুষের ভীড়ে সাধারণ হয়ে বেঁচে থাকতে। তিনি বলেন, “ক্রমাগত কিছু পাপ নিয়ে বেড়ে উঠা; তারপর মুক্তির পরম মোহে পাপতাড়ুয়া। চেষ্টা শুধু নিজের একান্ত আয়না সৃষ্টি করার, কেবল একবার নিজেকে খুঁটিয়ে দেখবো বলে। নিশ্চিত কোথাও লুকিয়ে আছে গন্তব্য। নিখুঁত আমি সেই গন্তব্যে যেতে চাই।” তিনি এই উপন্যাসটির নবম পর্ব লেখেন।

৮. নাঈফা চৌধুরী অনামিকা — জন্ম ঢাকাতে। কৈশোর থেকে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী। হাই স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অস্ট্রেলিয়াতেই। নাঈফা চৌধুরী অনামিকা অস্ট্রেলিয়ার মন্যাশ ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সিস্টেমস এবং তড়িৎকৌশলে স্নাতক। জাপানে কেটেছে বেশ কতগুলো বছর। বর্তমানে স্বামী এবং কন্যার সাথে সংযুক্ত আরব আমীরাতে থাকেন। ককেশীয়, মঙ্গোলীয়, সেমেটিক এবং দ্রাবিড় দলভুক্ত মানুষদের অকৃত্রিম বন্ধুত্বলাভের বিরল অভিজ্ঞতায় সৌভাগ্যবতী, অনামিকা স্বপ্ন দেখে যান লোভ, লালসা, প্রতিহিংসামুক্ত এক সুন্দর পৃথিবীর। তিনি এই উপন্যাসটির দ্বাদশ, অষ্টাদশ, বিংশ ও একাবিংশ পর্ব লেখেন।

৯. ময়ূখ রিশাদ (আরিশ)- নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, “নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে বলতে হয়, আমার গল্প দিয়ে হোক আমার পরিচয়। ডাক্তার হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, লেখালেখির স্বপ্নকে আলিঙ্গন করে গোড়ামীবিহীন পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষায় আছি।এক্স নটরডেমিয়ান, বর্তমানে পড়ছি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। শুভ হোক পথচলা, আমার, আপনার, সবার।” তিনি এই উপন্যাসটির দশম পর্ব লেখেন।

১০. আমিন শিমুল – নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, “নিজের সম্পর্কে বলবার তেমন কিছু নেই। পেশাগতভাবে তড়িৎ কৌশলী। লেখালেখি পেশা নেশা কোনটাই না বরং শুধুই নিজের আনন্দের জন্য। আমাদের ভিড়ে আমাকে খুঁজে বেড়াই।নিজের পরিচয় জোছনাস্নাত চন্দ্ররাতে অনিশেষ জোছনায় নিশোষিত অজানা দুঃখ বয়ে বেড়ানো চন্দ্রাহত এক দুঃখবিলাসী হিসাবে।” তিনি এই উপন্যাসটির একাদশ পর্ব লেখেন।

১১. অপাংক্তেয় (নাহিদ আফরোজ)- বরিশালে জন্ম। পেশায় উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদ। পড়তে, গান শুনতে ও ঘুরে বেড়াতে ভালবাসেন। ব্যক্তিগত জীবনে দু’ সন্তানের জননী। তিনি এই উপন্যাসটির চতুর্দশ পর্ব লেখেন।

১২. জ.ই মানিক — নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, “আত্মমগ্ন খ্যাপাটে; নিমগ্ন গর্তজীবি।/কঠোর, কোমল আদলজুড়ে/ছাপ যা ফুটুক বন্য,/বুকে নীরব রক্তক্ষরণ;/দহন, এক অরণ্য।” তিনি স্বপ্ন দেখেন এমন একটা সমাজ ব্যবস্থার, যেখানে বৈষম্য এবং ভেদাভেদ থাকবে না কোনও মানুষে মানুষে। মানুষ পরিচয়টাই মূখ্য হবে মানুষের, জাত-পাত ও অবস্থানের সীমারেখাকে উপড়ে ফেলে। এবং মানুষগুলোও মানুষ হয়ে উঠবে যথার্থ, মানবিক দায়বদ্ধতা, বোধ ও পরিশুদ্ধতায়। তিনি এই উপন্যাসটির পঞ্চদশ ও ঊনবিংশ পর্ব লেখেন।

এই উপন্যাসটির শুরু থেকেই চতুর্মাত্রিক ব্লগের শ্রদ্ধেয় ব্লগারগণ উৎসাহমূলক মন্তব্য দিয়ে সবসময় আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, আমাদের পাশে থেকেছেন। বিশেষ করে, সুরঞ্জনা, মেঘ অদিতি, একুয়া রেজিয়া, দর্শক, এ এ এম বিপ্লব, নয়ন, আব্দুর রাজ্জাক শিপন, শাওন, নুশেরা তাজরিন, তন্ময়, আব্দুল করিম, ফরিদুল আলম সুমন, বাপী হাসান, মেঘপরী শিলা, জলরঙ, মেঘরঙ, চৈতী আহমেদ, নির্মক্ষিক, স্রোত, বাতিঘর, ইমরান নিলয়, মুর্শেদ রূমী, ঈশান মাহমুদ, মাতরিয়শকা, অদ্ভুত আচার্য, ঝিনুক, মনির, নষ্টালজিক, কবি, শাপলা, তিশা, অর্থহীন, সকাল রয়, তারার হাসি, জুন প্রমুখ – তাঁদের প্রত্যকের কাছে আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ, একই সাথে আমরা কৃতজ্ঞ ‘চতুর্মাত্রিক’ ব্লগ এবং এর মডারেটরদের প্রতি। উপন্যাসটির খুব সুন্দর একটি প্রচ্ছদ করে দেবার জন্য মেঘ অদিতিকে আন্তরিক ধন্যবাদ। উপন্যাসে তাঁদের রচিত পংক্তিমালা ব্যবহার করতে দেওয়ায় গীতিকার ও লেখক শেখ রানা, গীতিকার রাসেল ও’নীল এবং হাসান মাহবুব এর প্রতি আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। উপন্যাসটির খুব সুন্দর একটি রিভিউ শত ব্যস্ততার মধ্যেও লিখে দেওয়ার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত সুরকার ও গীতিকার কবির বকুল ভাইয়াকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বাংলাদেশের প্রথম বারোয়ারী উপন্যাস প্রকাশে এগিয়ে আসায় অন্যপ্রকাশ এবং মাজহার ভাইকে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন। পরিশেষে এই বারোয়ারী উপন্যাসটিকে সম্পাদনা করে মলাটবন্দী করার জন্য শব্দপুঞ্জ (ফয়সল কাদের চৌধুরী), অপাংক্তেয় (নাহিদ আফরোজ), নাঈফা অনামিকা চৌধুরী, আকাশগঙ্গা (মিজানুর রহমান পলাশ), নাজমুল হুদা এবং ডাক্তারের রোজনামচা (ডাঃ এস এম নিয়াজ মাওলা) এর প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা।

সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

সরল রেখা-বক্র রেখাঃ ১৭তম পর্ব


( সরলরেখা – বক্ররেখাঃ ৩য় পর্ব
সরলরেখা – বক্ররেখাঃ ৭ম পর্ব
সরলরেখা – বক্ররেখাঃ অন্যান্য লেখকদের লেখা বাকী পর্বগুলো

সরলরেখা – বক্ররেখা — এই বারোয়ারি উপন্যাসটি এবারের ২১শের বইমেলাতে অন্যপ্রকাশ থেকে বের হচ্ছে)

আজ শুক্রবার। বন্ধের দিনে মিলন ঘুম থেকে উঠতে সবসময় একটু দেরী করে। সপ্তাহে এই একটি দিনেই ও যতো ঘুমিয়ে নিতে পারে। কিন্তু আজ বেশীক্ষণ ঘুমাতে পারলো না। গতকাল রাতেই সে সিরাজের মায়ের কুলখানি শেষ করে ঢাকায় এসেছে, শরীর এবং মন দুটোই খুব ক্লান্ত, তারপরও খুব সকালেই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। রুমের জানালা দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ ওর গায়ে এসে পড়ছে। বিছানাতে আধশোয়া হয়েই সে গত কয়েকদিনের কথা চিন্তা করছে।

চারদিন আগে হঠাৎ করে যখন হাবিবের কাছ থেকে সিরাজের মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পায়, প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। তারপর কোন কিছুই চিন্তা না করে দ্রুত চট্টগ্রামের দিকে রওয়ানা দেয়। সেখানে পৌঁছে সিরাজকে যতটা বিধ্বস্ত দেখবে ভেবেছিলো, তা না দেখে যেনো কিছুটা হতাশই হয়েছিলো। ভেবেছিলো পুরানো বন্ধুর এই বিপদের দিনে তার পাশে দাঁড়িয়ে নিকট অতীতের ছিন্ন সম্পর্কটাকে আবার জোড়া লাগাবে। সিরাজকে তার আন্তরিকই মনে হয়েছে, মনে হয়েছে পুরানো ইয়ার দোস্তকে কাছে পেয়ে সে খুবই উচ্ছ্বসিত, কিন্তু তাকে বা হাবিবকে সে কোনো কাজেই ডাকে নি। মাঝে মাঝে দেখা গেছে শামার পরামর্শ নিতে। একদিক থেকে অবশ্য ভালোই হয়েছে, সিরাজকে নিয়ে আর হাবিবকে নিয়ে সে অনেক চিন্তা করার অবসর পেয়েছে। আর অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়েছে সেলিনার কাছ থেকে কিছু পুরানো ক্ষতের প্রলেপ।

মরা বাড়ির ভীড়ের মধ্যে যখন সেলিনা মিলনের কাছে এসে বলে ওর সাথে কিছু কথা আছে, মিলন একটু অবাকই হয়েছিলো। তারপরও একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে সে সেলিনার সাথে কথা বলতে এগিয়ে যায়।

মিলন ভাইয়া, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সেদিন যদি আপনি আমার সাথে ওরকম ব্যবহার না করতেন, আমি হয়তোবা আজকের এই আমি হতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম না কিশোরী বয়সের সাময়িক আবেগের সাথে বাস্তব জীবনের কঠোরতার প্রভেদ। আপনার সেই চাবুকের কষাঘাতের মতো ‘না’ শব্দটিই যেনো আমাকে বাস্তবে নিয়ে এসেছে। প্রথম দিকে আপনাকে আমি অনেক ভুল বুঝেছি, ভীরু, কাপুরুষ ভেবেছি। কিন্তু কখনো বুঝতে চাই নি আপনার অবস্থাকে, মেনে নিতে পারি নি আমার জন্য, ফুপার অপমানজনক কথা শুনে আপনার অসহায়ভাবে বাসা থেকে চলে যাওয়াটাকে। মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো আমাদের পবিত্র ভাই-বোনের মতো সম্পর্কটাকে বাইরের কিছু লোকের অযাচিত কালি লেপনে। আমি হয়ে গিয়েছিলাম বিধ্বস্ত, এলোমেলো এক কিশোরী, যে তখন জীবন সাগরে ভেসে থাকার জন্য খড়কুটোও আকড়ে ধরতে চেয়েছিলো। এখন মনে হয়, যা কিছু হয়েছে সব বুঝি সবার মঙ্গলের জন্যই। আজ শুধু একটা অনুরোধই করবো আপনাকে, পারবেন সেই আগের মতো আমাকে ছোটবোন হিসেবে দেখতে? আপনি, সিরাজ ভাইয়া আর ভাইয়া, আপনারা তিনজন আমাদের বাসায় খাবার খেতে বসবেন, ছোটবোন হিসেবে আমি আপনাদেরকে আমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করে খাওয়াবো-পারবেন ভাইয়া আমার এই স্বপ্নটাকে সত্যি করতে?

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চোখের পানি মুছতে মুছতে যেনো সেলিনা মিশে গেল ভীড়ের মধ্যে, মিলন যেনো দাঁড়িয়ে রইলো হতবিহ্বল হয়ে স্থাণুর মতো। কিন্তু একইসাথে ওর মনে হলো, বুক থেকে যেনো এক বিশাল কষ্টের পাথর নেমে গেলো, অনেক দিনের একটা ক্ষতের উপর যেনো এক মায়ার, এক অন্যরকম বন্ধনের প্রলেপ পড়লো। বুক ভরা এক নিশ্বাস নিয়ে হেসে ফেললো মিলন, দূর থেকে দেখতে লাগলো অপসৃয়মান সেলিনাকে। মনটা ভরে উঠলো এক অনাবিল আনন্দে।

রুমমেটের ডাকাডাকিতে বর্তমানে এসে মিলন একটু হকচকিয়ে গেলো, তারপর ধাতস্থ হয়ে স্মিত হেসে বললো, “রুপম, তুই তো বাংলার ছাত্র, তাই না? রবীন্দ্রনাথের ‘অচল স্মৃতি’ কবিতাটি জানিস? আমার কিছু স্মৃতি অচল হয়ে গেছে”। রুপম মিলনের কথার মানে বুঝতে না পারলেও আগ্রহভরে আবৃত্তি করতে লাগলো-

“আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি ।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি………”

সাদা চাদরে আবৃত সুফিয়া খাতুনের বেডের পাশে চোখ-মুখ শুকনো করে কেমন স্থবির হয়ে বসে আছে সিরাজ। অনেক কিছুই ওর মনে আসছে, আবার চলেও যাচ্ছে। সেই ছোটবেলা থেকে এই আজ পর্যন্ত-সবকিছুই। সিরাজের বাবা অল্প বয়সে মারা যাবার পর সংসারের হাল ধরেন সুফিয়া খাতুন। গ্রামের বাড়িতে কীভাবে ছেলেকে বড় করে শহরের স্কুলে পড়িয়েছেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন। ছেলে আস্তে আস্তে বড় হলো, পড়াশোনা না করে টেকনিক্যাল লাইনে চলে গেলো। সুফিয়া খাতুন না করেন নি, সংসারে কিছু অর্থের সমাগম হবে এই আশায়। সিরাজ যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো, গ্রাম থেকে এসে আর যেতে চাইলেন না তিনি। সিরাজ সুস্থ হয়ে একটা বুটিকের দোকানের ব্যবস্থা করে দেয় মা কে। মা-ছেলে যখন একসাথে থাকবে, তখনই সিরাজ জেলে যায়। সুফিয়া খাতুন ছেলেকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, তাই ছেলের নেশা করা, বন্ধুদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, সবকিছুতেই প্রথমে আপত্তি করলেও, পরে তা মেনে নিতেন। সিরাজও তার মাকে খুব ভালোবাসত। বাইরের দুনিয়াতে তার সমস্ত দস্যুপনা মায়ের কাছে এসে শেষ হয়ে যেতো। সেই মায়ের হঠাৎ মৃত্যু যেনো সিরাজকে আক্ষরিক অর্থেই কিছুক্ষণের জন্য স্থবির করে দিলো।

শামা যখন ক্লিনিকে এসে সিরাজকে এভাবে দেখে, তখনই সিরাজ নিজেকে সামলে নেয়। ঠিক করে ওর কষ্টটাকে ও কাউকে বুঝতে দিবে না, ওর মায়ের শেষ কাজ ও নিজের হাতেই সব করবে। ঢাকা থেকে মিলন ছুটে আসে, হাবিবও আসে ওকে সঙ্গ দিতে। সবার সাথেই সে পুরানো দিনের মতোই ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে শামা এসে ওকে কিছু পরামর্শ দিয়েছে , ও শুনেছে, কিন্তু সব কাজ নিজের মতো করেই করেছে। নিজেকে শান্ত রেখেছে, চোখের পানিটুকু পর্যন্ত ফেলার অবকাশ দেয় নি। এমন কি মাকে কবরে রেখে এসেও নিজেকে ধরে রেখেছে।

কিন্তু কুলখানির পর যখন মিলন, হাবিব চলে গেলো, যেসব আত্মীয়-স্বজন এসেছিলো, তারা যখন বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে নিজেদের পথের দিকে রওয়ানা দিলো, ও যখন শূন্য, ফাঁকা ঘরটাতে একা ফিরে এলো, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। মায়ের শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো। গলার কাছে দলার মতো আটকে থাকা সমস্ত কিছু যেনো এক নিদারুণ চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে এলো।

“বন্ধন ? বন্ধন বটে , সকলি বন্ধন —
স্নেহ প্রেম সুখতৃষ্ণা ; সে যে মাতৃপাণি
স্তন হতে স্তনান্তরে লইতেছে টানি ,
নব নব রসস্রোতে পূর্ণ করি মন
সদা করাইছে পান । স্তন্যের পিপাসা
কল্যাণদায়িনীরূপে থাকে শিশুমুখে —
তেমনি সহজ তৃষ্ণা আশা ভালোবাসা
সমস্ত বিশ্বের রস কত সুখে দুখে
করিতেছে আকর্ষণ , জনমে জনমে
প্রাণে মনে পূর্ণ করি গঠিতেছে ক্রমে
দুর্লভ জীবন ; পলে পলে নব আশ
নিয়ে যায় নব নব আস্বাদে আশ্রমে ।
স্তন্যতৃষ্ণা নষ্ট করি মাতৃবন্ধপাশ
ছিন্ন করিবারে চাস কোন্‌ মুক্তিভ্রমে!”

শামার যে কী হলো, শামা নিজেই যেনো তা বুঝতে পারছে না। সিরাজের মায়ের মৃত্যুর পর সিরাজের কঠিন কিন্তু কোমল ব্যবহার দেখে শামা যেনো নিজেকেই স্থির রাখতে পারছিলো না। বার বার ভেবেছে, এই বুঝি সিরাজ ভেঙ্গে পড়লো, ছুটে গেছে সিরাজের কাছে, কিন্তু দেখেছে এক নিষ্কম্প সিরাজকে। কী অদ্ভুত সুন্দরভাবেই না সব কাজ শেষ করলো সিরাজ! মাঝে মাঝে কিছু পরামর্শ দিতে গিয়েছিলো, সিরাজ শুনেছে, কিন্তু কাজ করেছে নিজের মতো করে। মায়ের মৃত্যু যেনো সিরাজকে অনেক পরিবর্তন করে ফেললো। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো শামা।

সব কাজ শেষ করে একটু স্থিতি হতেই সিরাজের সাথে দেখা করতে গেলো শামা। খুব শান্তভাবে বলতে লাগলো,

তুই হয়তোবা জানিস না, আমি এবরশন করিয়েছি। হ্যাঁ, আমার মনের সাথে আমাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে, অনেক রাত আমার নিদ্রাহীন কেটেছে, তুই শুনে অবাক হবি, বোধহয় একটু রাগও করতে পারিস, মনে মনে কয়েকবার আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছি। কিন্তু কেনো জানি না, শেষ মূহুর্তে এই জীবনটাকে খুব ভালবেসে ফেললাম, নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চাইলাম। নাফিস আর নাফিস সংক্রান্ত সব ঝেড়ে ফেললাম। নতুন করে এই পথ চলায় হঠাৎই মনে হলো তুই সাথে থাকলে আমি খুব শক্তি পাবো, তুই সাথে থাকলে সব বাধা বিপত্তিটাকে পেরিয়ে যেতে পারবো। এক সময় তো তুই চেয়েছিলি আমার এই হাতটাকে ধরতে, আমি দিতে চাই নি, আজ আমি তোর হাত ধরতে চাইছি, শক্ত করে, তুই কি ধরতে দিবি না? জানি আমি, তোর শরীরে এক কঠিন রোগ বাসা বেধেছে, হয়তোবা খুব বেশী দিন তুই আমাদের সাথে নেই, কিন্তু যে ক’টা দিন আছিস, তোকে কি আমি আমার পাশে পাবো না?

হাবিব সিরাজের মায়ের কুলখানি শেষ করে বাসায় এসেছে। সেলিনাকে বললো এক কাপ চা করে দিতে। কিছুক্ষণ আগে মিলনকে ঢাকার বাসে তুলে দিয়েছে, মিলনের সাথে কথা বলে মনে হোল সেলিনার সাথে দূরত্বটা মনে হয় কেটে গেছে। খুব ভালো লাগলো হাবিবের। পুরানো অনেক কিছুই স্মৃতিপটে খেলা করে গেলো। মিলন আর সিরাজ – এই দুইজন ওদের জন্য অনেক করেছে, হাবিব চায় নি ওদের এই বন্ধুত্বের পথচলাটা যেনো বক্র রেখায় শেষ হয়, সবসময় চেয়েছে তা যেনো সরল রেখার মতো অন্তহীনভাবে চলে। যেমনভাবে চেয়েছে মিলির সাথে ওর সম্পর্কটার পরিণতি।

ঢাকাতে যেদিন মিলি আর শিহাবের সাথে ওর দেখা হলো, ও খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলো। মনে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে শিহাবকে ওর বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতোই মনে হয়েছিলো। মিলি খুব বুদ্ধিমতীর মতো শিহাব আর সিরাজকে সরিয়ে দিয়েছিলো। হাবিব ভেবেছিলো, সমস্ত ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাবে। কিন্তু মিলির কথা শুনে ও যেনো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো, কিছু সময়ের জন্য মুখে যেনো কোনো কথাই আসছিলো না। চট্টগ্রামে ফিরে এসে একা একা চিন্তা করে হাবিবের মনে হোল এই বেশ ভালো হয়েছে। সেলিনার দিয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যেনো হাবিবের কানে মিলির সেই কথাগুলোই বাজছিলো-

হাবিব ভাই,তুমি আমার সেই ছোটবেলা থেকে, যখনো ভালোবাসা কাকে বলে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারি নি, তখন থেকেই আমার মনে কিসের অনুভূতি যেনো সৃষ্টি করতে। তোমার সাথে খেলতে, তোমার সাথে কথা বলতে, তোমার সাথে ঝগড়া করতে, সবসময় তোমার পাশে থাকতে আমার খুব ভালো লাগতো। একটু বড়ো যখন হতে লাগলাম, ভালোবাসা শব্দটি যখন পরিচিত হতে লাগলো, মনে হলো, এটাই বুঝি ভালোবাসা। তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে লাগলাম। তোমাকে নিয়ে অনেক রঙ্গিন স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলাম। তুমি ঢাকায় আসার পর মনে হলো, এইবার আমি তোমাকে আমার মতো করে পাবো। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, বিধাতা ভাবেন আরেক। তুমি এক্সিডেন্ট করলে, অসুস্থ হয়ে প্রায় এক বছরের মতো হাসপাতাল আর পুনর্বাসন কেন্দ্রে রইলে। বিশ্বাস করো, সেই সময়টা আমি অসম্ভব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম, নিজেকে যেনো তিলে তিলে নিঃস্ব করে ফেলছিলাম। এমন সময়ই শিহাব এগিয়ে আসে আমাকে এই স্বেচ্ছা বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে। লাভগুরু, নির্ঝর আর কায়েস হয়ে যায় প্রতি রাতে আমার ভালোবাসার শিক্ষক। আমি যেনো নতুন করে ভালোবাসাকে বুঝতে শিখি, জানতে শিখি। ভালোবাসা যেনো একটু একটু করে আমার কাছে উন্মুক্ত হতে থাকে। আমি সেই সময়টাতেও তোমাকে নিয়ে ভেবেছি, কিন্তু জানো কী, অবাক হয়ে আমি আবিষ্কার করলাম, তোমার সাথে আমার কোনো ভালোবাসার দৃশ্য মনের কোনো ফ্রেমে নেই, ভালোবাসার জন্য উন্মুখ এই কিশোরী মিলি তোমাকে ভালোভাবে বোঝার কোনো সুযোগই পায় নি। হাবিব ভাই, আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসতে চাই, কিন্তু আমাকে একটু সময় দিবে কী? ভয় নেই, শিহাব আমাকে আর ভালোবাসে না, পৃথিবীর কোনো একপ্রান্তে হয়তোবা ওর জন্য কোনো এক রেমি অপেক্ষা করে আছে। আমি শুধু চাই, তোমাকেই ভালবাসতে, নিজের মতো করে ভালবাসতে, যে ভালোবাসাকে আমি চিনেছি, জেনেছি, সেই ভালোবাসায় আমি তোমাকে আলিঙ্গন করতে চাই, শুধু তার আগে চাই কিছুটা সময়, যেই সময়ের ভিতর আমি তোমাকে আরো নিগূঢ়ভাবে বুঝতে পারবো। আমি জানতে পারবো, খুঁজতে পারবো, এই আমি, মিলি, তোমাকে আসলেই ভালোবাসি কতটুকু, কতটুকু খাঁটি সেই ভালোবাসা। তুমি কী দেবে না আমায় সেই সময়টুকু?

হাবিব এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চায়ের কাপটা রাখতেই সেলিনার রুম থেকে শুনতে পেলো জিম ক্রসের গাওয়া ওর খুব প্রিয় একটা গান-

“Well, I know it’s kind of late
I hope I didn’t wake you
But what I got to say can’t wait I know you’d understand
Ev’ry time I tried to tell you
The words just came out wrong
So I’ll have to say I love you in a song

Yeah, I know it’s kind of strange
But ev’ry time I’m near you
I just run out of things to say
I know you’d understand
Ev’ry time I tried to tell you
The words just came out wrong
So I’ll have to say I love you in a song

Ev’ry time the time was right
All the words just came out wrong
So I’ll have to say I love you in a song

Yeah, I know it’s kind of late
I hope I didn’t wake you
But there’s something that I just got to say
I know you’d understand
Ev’ry time I tried to tell you
The words just came out wrong
So I’ll have to say I love you in a song”.