নিঝিনি (অনামিকা আপু, আপনার জন্য)

হঠাৎ করেই রেমির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। এই সময়ে রেমির ঘুম ভাঙ্গার কথা নয়। মাত্র সকাল সাতটা বাজে। আর সকালটাও লন্ডনের চিরাচরিত সকালের মতো। সূর্যের আলো ঝলমলে চেহারা দেখার কোনো আভাসই পাওয়া যাচ্ছে না। শীত শীত ভাব তো রয়েছেই। এই অবস্থায় রেমির ঘুম ভাঙ্গলেও বিছানা থেকে উঠে আসার কোনো ইচ্ছাই নেই কিন্তু রান্নাঘরের টুং টাং আওয়াজ শুনে শিহাবের জন্য মায়াই লাগছে। শিহাব রেমিকে কোনো কাজই এখন করতে দেয়না। রেমি অনেকবার চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবার শিহাবের ভালোবাসাময় জেদের কাছে হার মেনেছে। তাই শিহাবের জন্য মায়া লাগলেও রেমি চুপচাপ শুয়েই রইলো।

একটা ট্রেতে করে মামলেট, ব্রেড, কর্ণফ্লেক্স এবং কফি নিয়ে শিহাব যখন রুমে ঢুকলো, শুভ্র বিছানায় শ্বেত পরীর মতো শরীরটাকে এলিয়ে দেওয়া রেমি তখন দেওয়ালে ঝুলানো এক বাচ্চার পোস্টারের দিকে সুখী সুখী ভাব নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। শিহাব সেটা দেখে বলে উঠে, “জানি, যখন নিঝিনি আসবে তখন আর এই ছবির দিকে তাকানোরও সময় পাবেনা, সারাক্ষণ নিঝিনিকে নিয়েই থাকবে।” রেমি হেসে ফেললো। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “নিঝিনি নামটা কখন ফাইনাল করলে?” “গতরাতে তুমি যখন বললে, নিঝিনি মানে ভালোবাসার চিহ্ন, তখন তোমার কন্ঠস্বরের ভালো লাগা শুনেই ঠিক করেছি আমাদের মেয়ের নাম নিঝিনি রাখবো। এবার চুপচাপ খেয়ে নাও, আমাকে এখনই কাজে যেতে হবে।”

রেমি মনে মনে খুব খুশি হলো। ও শিহাবকে বলেনি, গতরাতে যখন ফোনে ওর বাবার সাথে কথা হয়েছে, তখন এই নামটা ওর বাবাই দিয়েছেন। বলেছে্ন নিঝিনি হবে রেমি আর শিহাবের ভালোবাসার চিহ্ন। রেমি খুব লজ্জা পেয়েছিলো, আস্তে করে জানতে চেয়েছিলো এটা কোন ভাষার শব্দ। ফোনের অপরপ্রান্তে রেমির বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, “তোর বিদ্বান জামাই, বর্তমানে তোর রাঁধুনি- শিহাবের কাছ হতে জেনে নিস!” রাতের কথাটা মনে পড়ায় আনমনে হেসে উঠলো রেমি। ঘুমাতে যাবার আগে হাল্কা চালে শিহাবকে বলেছিলো ওদের সন্তানের নাম নিঝিনি রাখলে কেমন হয়! শিহাব ওর কথা রেখেছে, রেমির খুব ভালো লাগছে।

রেমির এখন এডভান্স পর্যায়। বাংলাদেশ থেকে প্রায় প্রতিদিনই ওর বাবা-মা ফোন করে খবর নেয়, যেনো মনে হয় রেমির চেয়ে তারাই বেশী উত্তেজিত! কেনো হবে না? প্রথমবারের মতো নানু ভাই হতে যাচ্ছে, রেমি তো প্রথমে বলতেই চায়নি ছেলে হবে, না মেয়ে। বাবার কাতর অনুরোধ শুনে শেষ পর্যন্ত আর না বলে থাকতে পারেনি। আর মেয়ে হবে শুনে, একদিনও দেরী হয়নি, নাম ঠিক করে ফেলেছে! বাবারা বোধহয় এমনই হয়!

মেয়েরা নাকি সবসময় বাবা ঘেঁষা হয়, রেমি মনে হয় আরো বেশী। হবেই না বা কেনো? সেই ছোটবেলা থেকেই রেমির যতো আবদার, সব বাবার কাছে। বাবাও তেমনি কখনো মেয়েকে নিরাশ করেননি। আবার এরই মাঝে মেয়েকে দিয়েছেন স্পষ্টবাদী, সাহসী, ভদ্র আর আত্মসচেতন হওয়ার অমূল্য শিক্ষা এবং দিয়েছেন এক নির্লোভ ও দায়িত্বশীল সরকারী কর্মকর্তার মেয়ে হবার দুর্লভ অহংকার। রেমি কেনো ছেলে না হয়ে মেয়ে হলো, এটা নিয়ে রেমির মায়ের মনে কোনো কষ্ট থেকে থাকলেও, রেমির বাবা রেমিকেই করে রেখেছেন তার একমাত্র সন্তান হিসেবে। তাই বাবার সব ভালোবাসাই রেমি নিরংকুশভাবে পেয়েছে। বিয়ের পর যখন শিহাবের সাথে লন্ডনে চলে আসে, তখনো রেমি জানে বাবার এই ভালোবাসায় কেউ ভাগ বসাতে পারবেনা। কিন্তু এখন পারবে, এখন একজন এই ভালোবাসায় ভাগ বসাতে পারবে, সে নিঝিনি! হেসে ফেললো রেমি, ও কেমন মা হতে যাচ্ছে, যে তার মেয়েকে, এই পৃথিবীতে আসার আগেই প্রতিদ্বন্দী বানিয়ে ফেলছে!

ডোরবেলের শব্দে সচকিত হয়ে উঠে রেমি। এই সময়েতো কারো আসার কথা নয়! ধীরে ধীরে এসে সে দরোজা খুলে শিহাবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়ে গেলো। অসহায়ের হাসি দিয়ে শিহাব বলে উঠে, “কেমন আছো তুমি?” চমকে উঠে রেমি, ভুরু কুচকে তাকায় শিহাবের দিকে। দরোজা থেকে রেমিকে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে শিহাব, বলে, “খুব পানির পিপাসা পেয়েছে।” উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে রেমি, “কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ? উল্টাপাল্টা কথা বলছো কেনো?” নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না শিহাব, অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, “বাবা নেই!”
রেমি প্রথমে বুঝতে পারেনি, ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। শিহাবকে কিছু বলতে যাবে, তখনই মনে হলো শিহাবের বাবা চার বছর আগেই মারা গেছেন, রেমির আর শিহাবকে কিছু বলা হলো না।

********
কোনো এয়ারলাইন্সই রাজী হলো না রেমিকে নিয়ে বাংলাদেশে আসতে, রেমির এডভান্স প্রেগনেন্সীর জন্য। পাগলপ্রায় রেমিকে তিনদিনের মাথায় ভর্তি করা হলো হাসপাতালে।

কেবিনে শুয়ে থাকা রেমির দিকে শিহাব বাড়িয়ে দিলো নিঝিনিকে। আলতো করে নিঝিনির গালে হাত দিলো রেমি, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল।

নিঝিনির আর রেমির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠা হলো না!

(অনামিকা আপু, আপনার জন্য আমার খুব প্রিয় একজন মানুষের কিছু কষ্টের কাহিনী উপহার দিলাম, জানি না আপনার কেমন লাগবে!)

Leave a comment