(১)
মো. গোলাম মোস্তফা। ২৮ বছরের উচ্ছ্বল যুবক। সদা হাসিখুশি, আলাপী মোস্তফা। গ্রামের সবাই তাকে খুব পছন্দ করে, যে কারো যে কোনো প্রয়োজনে ডাক দিলেই মোস্তফাকে পাওয়া যাবে। কোথাও বিয়ে হবে, কণে বাড়ির সব আয়োজন মোস্তফা সামলাবে। কেউ মধ্যরাতে অসুস্থ হয়ে পড়লো, তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসবে মোস্তফা। কারো অর্থনৈতিক সমস্যা, মোস্তফা এগিয়ে আসবে। কোথাও কোনো খেলাধুলা হবে, মোস্তাফাকে ডাকো। এই হচ্ছে মোস্তফা, গ্রামের সবার মধ্যমনি। আর মোস্তফার মধ্যমনি হচ্ছে তার বাইক। যেখানেই যে কাজে যাবে, সবার আগে বাইকে করে মোস্তফা যাবে।
ইদানীং মোস্তফা খুব ব্যস্ত। সে বিয়ে করেছে প্রায় এক বছর হয়েছে। এখন সে বাবা হতে চলেছে। তার প্রথম সন্তান, বংশের প্রথম সন্তান। প্রতিদিন রাতে সে আর তার স্ত্রী ঘুমাবার সময় তাদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে, কল্পনার জাল বুনে। স্বামী, স্ত্রী খুনসুটি করে, বাচ্চাকে আগে ‘মা’ ডাক শিখাবে, না কি ‘বাবা’ ডাক শিখাবে। ‘বাবা’ ডাক শোনার প্রবল আতিশায্যে মোস্তফার সারারাত ঘুম হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকায়নের জন্য তারা জানে তাদের একটি ছেলে সন্তান হবে। ফুটফুটে, সুস্থ, সবল ছেলে সন্তান। মোস্তফার স্বপ্ন, ছেলেকে নিজের মতো করে গড়ে তুলবে। নিজে যা করতে পারেনি, ছেলেকে দিয়ে তা করাবে। ছেলের মধ্যেই নিজেকে ধরে রাখবে এই নশ্বর পৃথিবীতে। বাজারে নবজাতক শিশুদের নামকরণের অনেক বই পাওয়া যায়। প্রায় সবগুলো বই-ই মোস্তফার কেনা হয়ে গেছে। প্রতিদিন রাতে তারা এক একটি নাম পছন্দ করে, আর বাতিল করে। নাম রাখা আর হয় না।
আজ গ্রামের বাজারের মুন্সী মিয়ার চা দোকানে বসে মোস্তফা বন্ধুদের সাথে গল্প করছে। আজ হাঁটবার, সকালের দিকেই সে বাজারে এসেছে। অনাগত সন্তানের জন্য ব্যাগ ভর্তি খেলনা কিনে মুন্সী মিয়ার দোকানে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে এসেছে। রোযার দিন, অতএব চা-সিগারেটের বালাই নেই। বন্ধুরা অনেক কথা বলে যাচ্ছে। মীরসরাইয়ে ট্রাক উল্টে একচল্লিশ ছাত্রের মৃত্যু, সোনিয়া গান্ধীর হাতে তুলে দেওয়া দুইশত ভরি সোনার পদক, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশে আসা, সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবিদের আদালত অবমাননা বা পারস্পরিক হাতাহাতি-কী নেই সেই আড্ডায়! কিন্তু কোনো কিছুতেই মোস্তফা ঠিকমতো মন দিতে পারছে না। বন্ধুদের কথায় হা হু করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে আঙ্গুলের নখ কাটছে। এককথায়, মোস্তফাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।
দুইদিন আগেই মোস্তফার স্ত্রীর ইডিডি (Expected date of delivary)পার হয়ে গেছে। অথচ এখনো প্রসব বেদনা শুরু হয় নি। সে বুঝতে পারছে তার স্ত্রীকে এখনই ডাক্তার দেখানো উচিৎ, কিন্তু গ্রামীন সমাজের মুরুব্বীদের কিছু বাধা এখনো সে ডিঙ্গাতে পারে নি। তবে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, আর একদিন সে অপেক্ষা করবে। এরমধ্যে কিছু না হলে স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, কারো বাধাই সে তখন শুনবে না। রিয়াসাতের কথায় মোস্তফার মৌনব্রত ভঙ্গ হলো।
-কি রে, তুই কী কোনো কথা শুনছিস?
-হ্যা, আমি শুধু ‘বাবা’ ডাক শুনছি।
মোস্তফার ত্বরিত জবাবে সবাই হেসে উঠলো। এমন সময় মোস্তফার মোবাইল ফোনের রিং বেজে উঠলো। বাড়ি থেকে ফোন এসেছে।
প্রায় দুই ঘন্টা হলো মোস্তফার স্ত্রীর পানি ভেঙ্গেছে। বাড়িতে দাই মা এনে চেষ্টা করানো হচ্ছে, কিন্তু কোনো কিছুই হচ্ছে না। মোস্তফা মোবাইলে এই সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করলো স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। মুন্সী মিয়ার চা দোকান থেকে দ্রুত উঠে বাইকে করে ঝড়ের গতিতে বাড়ির দিকে যেতে লাগলো। ওর একটাই চিন্তা, স্ত্রীকে বাঁচাতে হবে, ‘বাবা’ ডাক শুনতে হবে। ছেলেকে দিয়ে ওর সমস্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময় ওর পাশে ছেলের মা-কেও থাকতে হবে। ভাবতে ভাবতে মোস্তফা যেনো উড়ে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। হঠাৎ করে ওর মাথাটা একটু চক্কর দিয়ে উঠলো। চোখের সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছে না, অন্ধকার ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে। বাইকের হ্যান্ডেলের উপর রাখা ওর হাত দুটি নিশ্চল হতে লাগলো। ছিটকে পড়লো মোস্তফা, দূরে কোথাও। তার পাশেই বাইকের চাকা দু’টো অনবরত ঘুরতে লাগলো।
(২)
১৩ই আগষ্ট থেকে ১৫ই আগষ্ট পর্যন্ত আমি ছুটিতে ঢাকায় ছিলাম। রোযার মাসে এই প্রথম পরিবারের (পরিবার বলতে শুধুমাত্র আমার সহধর্মিনী) সাথে ইফতার করার আনন্দে মন খুব পরিপূর্ণ। একই সাথে প্রিয় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের অকাল প্রয়ানে কিছুটা হতভম্ব। এই অবস্থায় ১৬ই আগষ্ট ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের বিরক্তিকর বাস যাত্রা শেষে দুপুরবেলায় যখন হাসপাতালে আসি, যাত্রাজনিত আলসেমীর কারণে ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীগুলো আর দেখতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু একটা রোগীর সামনে ইউসুফ ভাইয়ের (ডাঃ মো. ইউসুফ, রেজিস্ট্রার, নিউরো আইসিইউ) অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকাটাকে দেখে শরীরের সমস্ত আলস্য নিয়ে গুটি গুটি পায়ে রোগীটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
রোগীটিকে জীবন রক্ষাকারী মেশিনের সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। ব্রেইনের সিটি স্ক্যানে দেখলাম একটা বিশাল রক্তপাত, রোগীর বয়স আর রক্তপাতের জায়গা দেখে মনে হচ্ছে কোনো rupture aneurysm (মাথার ভিতরের কোনো কোনো রক্তনালীর দেয়াল জন্মগত কারণে বা অন্য কোনো কারণে, বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল জমে যাওয়া অথবা কিছু জেনেটিক কারনে দুর্বল হয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে, অনেক সময় সেটা ফেটে গিয়ে স্ট্রোকের কারণ ঘটায়)। বুকের এক্সরে দেখে বুঝতে পারলাম স্ট্রোকের সময় রোগী হয়তোবা বমি করেছিলো, সেটার কিছু অংশ শ্বাসনালী হয়ে ফুসফুসে গিয়ে aspiration pneumonia হয়েছে। মেশিনে দেওয়া সত্ত্বেও অক্সিজেন সাচুরেশন বাড়ছে না, শরীরের রক্তচাপ কমে যাচ্ছে, সবকিছু মিলিয়ে অবস্থা খুব আশাব্যাঞ্জক নয়। সাধারণত এই অবস্থায় রোগী খুব একটা ফেরত আসে না, তাই আমি ওখান থেকে চলে আসলাম। আসার আগে ফাইলে চোখ বুলিয়ে দেখলাম রোগীর নাম মো. গোলাম মোস্তফা, বয়স ২৮ বছর।
প্রায় ঘন্টাখানেক রোগীকে নিয়ে যুদ্ধ করার পর ইউসুফ ভাইয়া যখন একটু বিশ্রাম নিতে এলো, আমি উনার desperate মনোভাবের কারণ জানতে চাইলাম। “দুইদিন আগে রোগীটির একটি সন্তান হয়েছে, ছেলে সন্তান, প্রথম সন্তান। তখন সে ভেন্টিলেটর মেশিনে, ছেলে জন্মানোর খবর জানে না। তোমার ভাবীও সন্তানসম্ভবা। আমি যেমন চাই, আমার সন্তানকে আমি দেখি, আমার সন্তান আমাকে দেখুক, ঠিক তেমনি ভীষনভাবে চাচ্ছি এই বাচ্চাটিও তার বাবাকে দেখুক, বাবাও তার বাচ্চাকে দেখুক। জানি না এই অসম যুদ্ধে জিতবো কী না, তবুও যতক্ষন শ্বাস, ততক্ষন আশ,” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন ইউসুফ ভাইয়া।
(৩)
ইউসুফ ভাইয়া এখনও যুদ্ধ করে যাচ্ছেন তাঁর সমস্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতা নিয়ে মোস্তফাকে বাঁচানোর জন্য, আর মোস্তফা যুদ্ধ করে যাচ্ছে মৃত্যুর সাথে, তার সন্তানের কাছ হতে ‘বাবা’ ডাক শুনবার জন্য, সন্তানকে ‘বাবা’ ডাকার সুযোগ করে দেবার জন্য।
(এই লেখাটা ইউসুফ ভাইয়াকে উৎসর্গ করা, যিনি এক সন্তানের কাছে তার বাবাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য দিন-রাত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।)