আমি ‘বাবা’ ডাক শুনতে চাই……আমি ‘বাবা’ ডাকতে চাই

(১)

মো. গোলাম মোস্তফা। ২৮ বছরের উচ্ছ্বল যুবক। সদা হাসিখুশি, আলাপী মোস্তফা। গ্রামের সবাই তাকে খুব পছন্দ করে, যে কারো যে কোনো প্রয়োজনে ডাক দিলেই মোস্তফাকে পাওয়া যাবে। কোথাও বিয়ে হবে, কণে বাড়ির সব আয়োজন মোস্তফা সামলাবে। কেউ মধ্যরাতে অসুস্থ হয়ে পড়লো, তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসবে মোস্তফা। কারো অর্থনৈতিক সমস্যা, মোস্তফা এগিয়ে আসবে। কোথাও কোনো খেলাধুলা হবে, মোস্তাফাকে ডাকো। এই হচ্ছে মোস্তফা, গ্রামের সবার মধ্যমনি। আর মোস্তফার মধ্যমনি হচ্ছে তার বাইক। যেখানেই যে কাজে যাবে, সবার আগে বাইকে করে মোস্তফা যাবে।

ইদানীং মোস্তফা খুব ব্যস্ত। সে বিয়ে করেছে প্রায় এক বছর হয়েছে। এখন সে বাবা হতে চলেছে। তার প্রথম সন্তান, বংশের প্রথম সন্তান। প্রতিদিন রাতে সে আর তার স্ত্রী ঘুমাবার সময় তাদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে, কল্পনার জাল বুনে। স্বামী, স্ত্রী খুনসুটি করে, বাচ্চাকে আগে ‘মা’ ডাক শিখাবে, না কি ‘বাবা’ ডাক শিখাবে। ‘বাবা’ ডাক শোনার প্রবল আতিশায্যে মোস্তফার সারারাত ঘুম হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকায়নের জন্য তারা জানে তাদের একটি ছেলে সন্তান হবে। ফুটফুটে, সুস্থ, সবল ছেলে সন্তান। মোস্তফার স্বপ্ন, ছেলেকে নিজের মতো করে গড়ে তুলবে। নিজে যা করতে পারেনি, ছেলেকে দিয়ে তা করাবে। ছেলের মধ্যেই নিজেকে ধরে রাখবে এই নশ্বর পৃথিবীতে। বাজারে নবজাতক শিশুদের নামকরণের অনেক বই পাওয়া যায়। প্রায় সবগুলো বই-ই মোস্তফার কেনা হয়ে গেছে। প্রতিদিন রাতে তারা এক একটি নাম পছন্দ করে, আর বাতিল করে। নাম রাখা আর হয় না।

আজ গ্রামের বাজারের মুন্সী মিয়ার চা দোকানে বসে মোস্তফা বন্ধুদের সাথে গল্প করছে। আজ হাঁটবার, সকালের দিকেই সে বাজারে এসেছে। অনাগত সন্তানের জন্য ব্যাগ ভর্তি খেলনা কিনে মুন্সী মিয়ার দোকানে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে এসেছে। রোযার দিন, অতএব চা-সিগারেটের বালাই নেই। বন্ধুরা অনেক কথা বলে যাচ্ছে। মীরসরাইয়ে ট্রাক উল্টে একচল্লিশ ছাত্রের মৃত্যু, সোনিয়া গান্ধীর হাতে তুলে দেওয়া দুইশত ভরি সোনার পদক, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশে আসা, সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবিদের আদালত অবমাননা বা পারস্পরিক হাতাহাতি-কী নেই সেই আড্ডায়! কিন্তু কোনো কিছুতেই মোস্তফা ঠিকমতো মন দিতে পারছে না। বন্ধুদের কথায় হা হু করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে আঙ্গুলের নখ কাটছে। এককথায়, মোস্তফাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।

দুইদিন আগেই মোস্তফার স্ত্রীর ইডিডি (Expected date of delivary)পার হয়ে গেছে। অথচ এখনো প্রসব বেদনা শুরু হয় নি। সে বুঝতে পারছে তার স্ত্রীকে এখনই ডাক্তার দেখানো উচিৎ, কিন্তু গ্রামীন সমাজের মুরুব্বীদের কিছু বাধা এখনো সে ডিঙ্গাতে পারে নি। তবে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, আর একদিন সে অপেক্ষা করবে। এরমধ্যে কিছু না হলে স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, কারো বাধাই সে তখন শুনবে না। রিয়াসাতের কথায় মোস্তফার মৌনব্রত ভঙ্গ হলো।

-কি রে, তুই কী কোনো কথা শুনছিস?
-হ্যা, আমি শুধু ‘বাবা’ ডাক শুনছি।

মোস্তফার ত্বরিত জবাবে সবাই হেসে উঠলো। এমন সময় মোস্তফার মোবাইল ফোনের রিং বেজে উঠলো। বাড়ি থেকে ফোন এসেছে।

প্রায় দুই ঘন্টা হলো মোস্তফার স্ত্রীর পানি ভেঙ্গেছে। বাড়িতে দাই মা এনে চেষ্টা করানো হচ্ছে, কিন্তু কোনো কিছুই হচ্ছে না। মোস্তফা মোবাইলে এই সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করলো স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। মুন্সী মিয়ার চা দোকান থেকে দ্রুত উঠে বাইকে করে ঝড়ের গতিতে বাড়ির দিকে যেতে লাগলো। ওর একটাই চিন্তা, স্ত্রীকে বাঁচাতে হবে, ‘বাবা’ ডাক শুনতে হবে। ছেলেকে দিয়ে ওর সমস্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময় ওর পাশে ছেলের মা-কেও থাকতে হবে। ভাবতে ভাবতে মোস্তফা যেনো উড়ে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। হঠাৎ করে ওর মাথাটা একটু চক্কর দিয়ে উঠলো। চোখের সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছে না, অন্ধকার ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে। বাইকের হ্যান্ডেলের উপর রাখা ওর হাত দুটি নিশ্চল হতে লাগলো। ছিটকে পড়লো মোস্তফা, দূরে কোথাও। তার পাশেই বাইকের চাকা দু’টো অনবরত ঘুরতে লাগলো।

(২)

১৩ই আগষ্ট থেকে ১৫ই আগষ্ট পর্যন্ত আমি ছুটিতে ঢাকায় ছিলাম। রোযার মাসে এই প্রথম পরিবারের (পরিবার বলতে শুধুমাত্র আমার সহধর্মিনী) সাথে ইফতার করার আনন্দে মন খুব পরিপূর্ণ। একই সাথে প্রিয় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের অকাল প্রয়ানে কিছুটা হতভম্ব। এই অবস্থায় ১৬ই আগষ্ট ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের বিরক্তিকর বাস যাত্রা শেষে দুপুরবেলায় যখন হাসপাতালে আসি, যাত্রাজনিত আলসেমীর কারণে ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীগুলো আর দেখতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু একটা রোগীর সামনে ইউসুফ ভাইয়ের (ডাঃ মো. ইউসুফ, রেজিস্ট্রার, নিউরো আইসিইউ) অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকাটাকে দেখে শরীরের সমস্ত আলস্য নিয়ে গুটি গুটি পায়ে রোগীটার দিকে এগিয়ে গেলাম।

রোগীটিকে জীবন রক্ষাকারী মেশিনের সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। ব্রেইনের সিটি স্ক্যানে দেখলাম একটা বিশাল রক্তপাত, রোগীর বয়স আর রক্তপাতের জায়গা দেখে মনে হচ্ছে কোনো rupture aneurysm (মাথার ভিতরের কোনো কোনো রক্তনালীর দেয়াল জন্মগত কারণে বা অন্য কোনো কারণে, বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল জমে যাওয়া অথবা কিছু জেনেটিক কারনে দুর্বল হয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে, অনেক সময় সেটা ফেটে গিয়ে স্ট্রোকের কারণ ঘটায়)। বুকের এক্সরে দেখে বুঝতে পারলাম স্ট্রোকের সময় রোগী হয়তোবা বমি করেছিলো, সেটার কিছু অংশ শ্বাসনালী হয়ে ফুসফুসে গিয়ে aspiration pneumonia হয়েছে। মেশিনে দেওয়া সত্ত্বেও অক্সিজেন সাচুরেশন বাড়ছে না, শরীরের রক্তচাপ কমে যাচ্ছে, সবকিছু মিলিয়ে অবস্থা খুব আশাব্যাঞ্জক নয়। সাধারণত এই অবস্থায় রোগী খুব একটা ফেরত আসে না, তাই আমি ওখান থেকে চলে আসলাম। আসার আগে ফাইলে চোখ বুলিয়ে দেখলাম রোগীর নাম মো. গোলাম মোস্তফা, বয়স ২৮ বছর।

প্রায় ঘন্টাখানেক রোগীকে নিয়ে যুদ্ধ করার পর ইউসুফ ভাইয়া যখন একটু বিশ্রাম নিতে এলো, আমি উনার desperate মনোভাবের কারণ জানতে চাইলাম। “দুইদিন আগে রোগীটির একটি সন্তান হয়েছে, ছেলে সন্তান, প্রথম সন্তান। তখন সে ভেন্টিলেটর মেশিনে, ছেলে জন্মানোর খবর জানে না। তোমার ভাবীও সন্তানসম্ভবা। আমি যেমন চাই, আমার সন্তানকে আমি দেখি, আমার সন্তান আমাকে দেখুক, ঠিক তেমনি ভীষনভাবে চাচ্ছি এই বাচ্চাটিও তার বাবাকে দেখুক, বাবাও তার বাচ্চাকে দেখুক। জানি না এই অসম যুদ্ধে জিতবো কী না, তবুও যতক্ষন শ্বাস, ততক্ষন আশ,” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন ইউসুফ ভাইয়া।

(৩)

ইউসুফ ভাইয়া এখনও যুদ্ধ করে যাচ্ছেন তাঁর সমস্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতা নিয়ে মোস্তফাকে বাঁচানোর জন্য, আর মোস্তফা যুদ্ধ করে যাচ্ছে মৃত্যুর সাথে, তার সন্তানের কাছ হতে ‘বাবা’ ডাক শুনবার জন্য, সন্তানকে ‘বাবা’ ডাকার সুযোগ করে দেবার জন্য।

(এই লেখাটা ইউসুফ ভাইয়াকে উৎসর্গ করা, যিনি এক সন্তানের কাছে তার বাবাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য দিন-রাত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।)

একটি সাধারণ গল্প

(১)

আমি আনিসুর রহমান। এটা আমার ছদ্ম নাম, কেনো আমি আসল নাম দিচ্ছি না, আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আমি ঢাকায় থাকি, একটি বহুজাতিক কোম্পানীতে কর্মরত আছি। বয়স ধরুন পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের ভিতর। আমি বিবাহিত, আমার স্ত্রী মারুফা। সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে- মারুফাকে দেখলেই তা মনে হয়, আমার কাছে আমার দেখা সবচেয়ে রুপবতী এবং গুনবতী মহিলা। আমার দুইটি পরী আছে, একজনের বয়স পাঁচ বছর, নাম অর্পা। আরেকজনের বয়স তিন বছর, নাম পূর্বা। আমাদের এই চারজনের ছোট্ট সংসার খুব ভালোভাবেই চলছিল।

হঠাৎ একদিন একটি খবর এই সুখের সংসারের সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। অনেকদিন ধরেই মারুফা একটি সমস্যার কথা বলছিল। অফিস থেকে সময় বের করতে পারি নি, আলসেমীও কম দায়ী নয়, বেশকিছু দিন পর ডাক্তার দেখানোর পর যা জানতে পারলাম, খুব ভালো লাগলো না। ডাক্তার বলছেন, মারুফার নাকি ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে। আগে অপারেশন করতে হবে, তারপর অবস্থা বুঝে কেমো বা রেডিওথেরাপী।

আমিও হাইপারটেনশনের রোগী। মারুফার এই অবস্থায় একটু ঘাবড়েই গেলাম, কিন্তু মনোবল হারাইনি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাহসের দিন ছিল মারুফাকে জানানো। ওকে বলার পর দেখলাম, কিছুক্ষন চুপ ছিলো, তারপর হাসিমুখে বললো, কবে অপারেশনের টেবিলের নিচে শুতে হবে। বুক থেকে সঙ্গো্পনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

মেয়ে দু’টিকে নানা বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। এরপর এলো সেই দিন। ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতালে অপারেশন করা হলো। ডাক্তার বললেন, অপারেশন সফল হয়েছে। চিকিৎসার পরবর্তী ধাপ নির্ভর করবে বায়োপসি রিপোর্টের উপর। পোস্ট-অপারেটিভ রুমে মারুফাকে দেখতে গেলাম। হাসিমুখে আমাকে পাশে বসে ওর হাতটা ধরে থাকতে বললো। আমি তাই করলাম।

(২)

আমি মারুফা রহমান। এটা আমার ছদ্ম নাম, কেনো আমি আসল নাম দিচ্ছি না, আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আমি একজন গৃহিনী, সংসার সামলানোই আমার কাজ। আমার পরিচিতজনেরা বলেন আমি নাকি এই কাজটা খুব সুন্দরভাবে করতে পারি। আমার স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসেন, তারচেয়েও বেশী ভালোবাসেন আমাদের দুই পরী অর্পা আর পূর্বাকে।

গত কিছুদিন ধরে আমার ব্রেস্টে ব্যথা করছে। আমার স্বামীকে বলার পর একদিন আমরা ডাক্তার দেখাতে গেলাম। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে দিলেন। রিপোর্ট গুলো দেখে আমার স্বামীকে আলাদাভাবে কি যে বললেন, তারপর থেকেই তাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখলাম। কিছু একটা আমাকে বলতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না।

অবশেষে একদিন আমার কাছে এসে বললো একটা কথা বলবে। আমি ঠিক করেছি যত কঠিন কথাই হোক তা হাসিমুখে শুনবো। সে আমাকে বললো, আমার ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে, অপারেশন করতে হবে। এরপর বায়োপসি রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কেমো বা রেডিওথেরাপী দিবে। আমি অভয় দিলাম।

মেয়ে দু’টিকে নানা বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। এরপর এলো সেই দিন। ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতালে অপারেশন করা হলো। ডাক্তার বললেন, অপারেশন সফল হয়েছে। কিছুক্ষন পর দেখলাম আমার স্বামী আমাকে দেখতে আসলো। কেনো জানি না হঠাৎ করে আমার মনে হলো আমি বোধহয় আর ভালো হবো না। আমার ছোট্ট দুইটা মেয়ের কথা মনে পড়লো। আমার স্বামীকে বললাম আমার হাত ধরে বসে থাকতে, সে তাই করলো। হঠাৎ আমার হাতের উপর তার চোখের পানি পরলো, শক্ত করে আমরা হাত ধরে থাকলাম।

(৩)

আজ এক সপ্তাহ হলো মারুফার রেডিও থেরাপী চলছে, সিরাজগঞ্জের কেওয়াইএএমসিএইচে। ওর বায়োপসি রিপোর্ট ভালো আসেনি, ক্যান্সারটা শেষ পর্যায়ে। আমরা অনেক দেরী করে ফেলেছি। মারুফার মাথার চুল সব পরে যাচ্ছে, চেহারা কেমন যেন শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব কষ্ট লাগছে, খুব।

আজ মারুফা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। ডাক্তাররা বলছেন, তারা চেষ্টা করছেন, কিন্তু ভরসা পাচ্ছেন না। আমার শরীরটাও খুব ভালো যাচ্ছে না। প্রেশারের ওষুধ ঠিকমতো খাওয়া হচ্ছে না, খুব দুর্বল লাগছে। একটু বিশ্রাম নেওয়া উচিৎ।

(৪)

গত দুই দিন ধরে আমার কিছুটা ভালো লাগছে। ডাক্তাররা বলেছিলেন, আমি নাকি প্রায় তিনদিন অজ্ঞান ছিলাম, যমে মানুষে টানাটানি। আমার স্বামী না কি খুব কষ্ট করেছে, এই ক’দিন। সারাক্ষন আমার পাশে ছিলো। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, নাওয়া কিছুই হয়নি তার। ওর নিজেরও প্রেশারের সমস্যা। আমার জ্ঞান ফেরার পর ওর সাথে আমার দেখা হয়নি। আমার দেবর বললো, সে না কি অফিসের জরুরী কাজে ঢাকায় গেছে, আসতে কিছুদিন সময় লাগবে। মেয়েদেরকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।

(৫)

আমি নিয়াজ, একজন ডাক্তার, নিউরোসার্জন। পাঁচদিন আগে রাত দুইটার সময় ইমার্জেন্সীভাবে হাসপাতালে আসতে হয়েছিলো। একজন ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে ইমার্জেন্সীতে এসেছে। সিটি ব্রেন করে দেখা গেলো বিশাল বড় একটা হেমোরেজ, ব্রেন স্ট্রোক করেছে, অবস্থা খুব ভালো না। রোগীর সাথের লোকদের কাছ হতে শুনলাম, রোগীর স্ত্রী এই হাসপাতালেই ক্যান্সার বিভাগে ভর্তি আছে, রেডিও থেরাপী পাচ্ছে। গত দুই দিন ধরে সে অজ্ঞান হয়ে আছে, এই চিন্তায় তার স্বামী খুব অস্থির ছিলেন। প্রেশারের রোগী ছিলেন, ঠিকমতো ওষুধও খান নি।

আজ সকালে রোগীটি মারা গেছেন। আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম, সম্ভব হয় নি। শুনতে পারলাম, তার স্ত্রীর না কি জ্ঞান ফিরেছে, স্বামী যে একই হাসপাতালে ভর্তি তা জানতেন না। তাকে তার স্বামীর মৃত্যুর খবরও দেওয়া হয়নি। তাদের ছোট ছোট দুইটি মেয়েও আছে। খুব খারাপ লাগছে আমার, খু-উ-ব।

(৬)

পাদটীকাঃ আনিসুর রহমান মারা যাবার এক সপ্তাহ পর তার স্ত্রী মারুফা রহমানও মারা যান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মারুফা জানতেন তার স্বামী বেঁচে আছেন।

এটি একটি সাধারণ গল্প নয়, একটি সাধারণ সত্য কাহিনী।

বিশেষ এক দিন …………

রাত ১ টা বাজে । মোবাইলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল । রতন ভাইয়া, আমার খুব ঘনিষ্ঠ প্রিয় মানুষ, ফোন করেছে । তার বাবার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছে । আমি আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসতে বললাম, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারীতে । তাদের আসতে আসতে রাত ৪ টা বেজে গেলো । ব্রেইনে বিশাল বড় একটা রক্তক্ষরন হয়েছে । বেচেঁ থাকার সম্ভাবনা খুবই কম । ভর্তি করে লাইফ সাপোর্ট দিতে দিতে পুব আকাশে সূর্য উঠে গেলো ।

সকালে একটা ব্রেইন টিউমার রোগীর রুটিন অপারেশন ছিল- ৩৫ বছরের এক তরতাজা যুবক । ছোট্ট একটা ছেলে আছে, জমি বিক্রি করে অপারেশন করতে এসেছে । জটিল অপারেশন । টিউমারের জন্য চোখে দেখতে পারছে না, অপারেশন সফল হলে হয়তোবা, হয়তোবা সে দেখতে পারবে। প্রায় ৭ ঘন্টা ধরে অপারেশন চলল, আমরা তাকে পরিপূর্ণ সজাগ করলাম না। এদিকে প্রায় বিকাল ৪ টা, দুপুরের খাবার খেতে বসবো, ইমার্জেন্সী কল আসলো ।

১৫ বছরের এক ছেলে, নসিমনের (দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যবহৃত এক বিশেষ ধরনের যান) সাথে ধাক্কা লেগে অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে এসেছে । সিটি স্ক্যান করে দেখা গেলো এপিডুরাল হেমোরেজ (ব্রেইনের সবচেয়ে উপরের কভারে রক্তপাত, যা দ্রুত অপারেশন করলে রোগী সুস্থ হয়ে যায়) । শরীরে রাত জাগরনের ছাপ, টানা ৭ ঘন্টা ধরে অপারেশন করার ক্লান্তি, অন্যদিকে রোগীর জীবন ।

আবারও অপারেশন থিয়েটারে, আবারও ২ ঘন্টা ধরে অপারেশন । কিন্তু চোখে-মুখে সাফল্যের পরিতৃপ্তি, ছেলেটার যে জ্ঞান ফিরে এসেছে, সে যে কথা বলতে পারছে । ব্রেইন টিউমারের রোগীও সম্পূর্ণ সজাগ হয়েছে এবং সে চোখেও একটু একটু দেখতে পারছে । মন টা অনাবিল আনন্দে ভরে উঠলো ।

মানসিক প্রশান্তি নিয়ে ক্লান্ত শরীরে যখন বাসার দিকে রওয়ানা দিবো, ঠিক তখনিই রতন ভাইয়ার বাবা খারাপ হয়ে গেলো । বাসায় আর যাওয়া হলো না । অনেকক্ষন চেষ্টা করার পর রাত ২ টার দিকে উনি এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অন্যভুবনে চলে গেলেন । সব কিছু ঠিক করে বাসায় ফিরতে ফিরতে আবারো সকাল হয়ে গেলো ।

৪৮ ঘন্টার ক্লান্তিতে বিছানাকে খুব আপন মনে হলো ।

দুপুরে ঘুম ভাঙ্গলো সহধর্মিনীর ফোনে- খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো হয়েছে কিনা । মুখে খাবার দিয়েছি কি দিই নি, ঢাকা থেকে আমার ছোট বোনের ফোন—“ভাইয়া, আব্বু আর নেই, অফিসে সিড়িতে পড়ে গিয়ে মাথায় রক্তপাত হয়ে হাসপাতালে নেবার আগেই মারা গেছেন”—ওর কান্নায় আর কিছু শুনতে পারছিলাম না, আমার কান্নায় চোখে কিছু দেখতে পারছিলাম না ।

আমি যখন ঢাকার পথে, রতন ভাইয়া ফোন দিল উনার বাবার দাফন হয়ে গেছে জানাবার জন্য, আমি উনাকে জানালাম আমি ঢাকায় যাচ্ছি আমার বাবাকে দাফন দেবার জন্য। ফোনের দুই প্রান্তেই অনেকক্ষন ধরে কোনো শব্দ নেই, শুধু ফোপানোর আওয়াজ ছাড়া ।

কেওয়াইএএমসিএইচ,
২০/০৪/২০১১

ওসামা বিন লাদেন, আলেক্সজান্দ্রা এবং একজন রোগী……

আজ আমার সারাদিন ছুটি। কোনো রোগী দেখা নেই, বাজার করা নেই, শুধু ঘুম আর ঘুম।ছুটির দিনে এমনিতেই দেরী করে ঘুম থেকে উঠি, আজ আরো দেরীতে। সহধর্মিনী অবশ্য সকাল থেকেই বকর বকর করে যাচ্ছে, আমি খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিনা। ছুটির দিনে আমার আরো একটা অভ্যাস আছে, সেটা হলো মুভি দেখা। আমি সাধারনত হলিউডের মুভি দেখি।বিছানাতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিলাম কি মুভি দেখা যায়। এমন সময় লিসা (যে সারাক্ষন ধরে বকর বকর করে যাচ্ছে)সকালের পত্রিকা হাতে নিয়েই চিৎকার করে উঠল।

ওসামা বিন লাদেন
ওসামা বিন লাদেন

গতকাল রাতে আমরা কেউ-ই ব্যস্ততার জন্য টিভিতে খবর শুনতে পারিনি, সে জন্য ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকান্ডের খবর জানতেই পারিনি। কালের কন্ঠে ওসামার সৌ্ম্য, সুন্দর চেহারা দেখে মায়াই লাগছিলো। পরক্ষনেই মনে হলো এই মানুষটার জন্য অনেক নিরীহ মানুষ মারা গেছেন, ইসলামকে বলা হচ্ছিল সন্ত্রাসের ধর্ম। এই আল-কায়েদাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা অনেক রাষ্ট্রকেই আক্রমনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিলো।যা হোক অবশেষে লাদেন মারা পড়লো! কিন্তু এ কি?লাশ কেনো সাগরে সমাহিত করা হলো? জানি না, যেমন জানি না পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীর নাকের ডগায় সে কিভাবে এতদিন ছিলো আর সেটা কেনো পাকিস্তান সরকার জানে না? আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কি?

ছুটির দিনটাতে এইসব ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চাই। অতএব, ওসামা বিন লা্দেন বাদ। আজ Young Victoria দেখবো ঠিক করেছি, এই মহিলাকে না কি বলা হতো Grandmother of Europe। তাঁর নাতী-নাতনীদের মধ্যে ব্রিটিশ রাজ, জার্মান কাইজার, গ্রীস, রুমানিয়া, নরওয়ে, স্পেন-এর রানী থেকে শুরু করে রাশিয়ার শেষ জারিনা আলে্কসজান্দ্রা পর্যন্ত ছিলো। আলে্কসজান্দ্রার কথায় মনে পড়লো রুশ বিপ্লবের সময় তাকে তাঁর পরিবারের সকল সদস্যসহ লেনিনের আদেশে হত্যা করা হয়, ঠিক যেন বঙ্গবন্ধুর মতো।
রাশিয়ার শেষ জারিনা আলেক্সজান্দ্রা
রাশিয়ার শেষ জারিনা আলেক্সজান্দ্রা

কথায় আছে না, সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। আমার হয়েছে সে দশা।দুপুরে খেয়ে কৈ একটু সুখনিদ্রা দিবো, তা না- আমাকে ভুতে কিলালো আমার সহকর্মী হাসপাতালে কি দূরবস্থার মধ্যে আছে তা দেখার জন্য হাসপাতালে যাওয়া। হাসপাতালে এসেই দেখি আড়াই বছরের এক ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে জীবন-মরন খেলায় মগ্ন আমার সহকর্মী, যাকে আমি ইউসুফ ভাইয়া বলে ডাকি। উনার কাছ হতেই শুনলাম সকালে বাচ্চাটি বাবা-মার সাথে রিকশায় যাচ্ছিলো, পিছন হতে একটি বাস ঢাক্কা দেয়, বাবা-মার কারোই কিছু হয়নি, শুধু বাচ্চাটি ছাড়া। অতিদ্রুত সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু সেখানে মাথায় আঘাতের চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় তারা বাচ্চাটিকে আমাদের এখানে পাঠিয়ে দেয়।

ইউসুফ ভাইয়া খেলায় হেরে গেলো। খুব শান্তভাবে বাচ্চার বাবা-মাকে বললো-আপনাদের ছেলেকে আমরা অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলাম না। আমি ইউসুফ ভাইয়ের কাজে একটু সাহায্য করলাম-মৃত্যুর সনদপত্র লিখে দিয়ে। নিজেরা কথা বলছিলাম এই সপ্তাহের mortality meeting-আরেকটা রোগী বাড়লো।

হাসপাতাল থেকে যখন বের হচ্ছিলাম তখন দেখলাম বাচ্চার মা কাঁদছে আর বলছে “ আল্লাহ আমাকে না নিয়ে আমার বাচ্চাকে নিলে কেনো?” আমি মাথা নত করে ধীর পায়ে বাসার দিকে আসতে লাগলাম।

কেওয়াইএএমসিএইচ,
০৩/০৫/২০১১

আমার মনটা খুব খারাপ, খু-উ-ব…………

অনেকদিন আগের কথা। নিশাত। ১০ বছরের ছোট্ট মায়াকাড়া এক মেয়ে। প্রথম যে দিন আমাদের কাছে আসলো ওর চাহনির মধ্যে অজস্র যন্ত্রনা যেন দেখতে পেয়েছিলাম, এক মাস ধরে সে কোমরের ব্যথায় হাটতে পারছিল না। আমরা নিশাতকে আমদের ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে নিলাম।

আইসিইউ-তে রোগীর সাথে কেউ থাকতে পারেনা, নিশাতের সাথেও কেউ থাকতে পারলো না। নার্সরা ওকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখতে চাইলো। ওর কচি নিষ্পাপ মন মানলো না।মাকে ছাড়া কিছুতেই কিছু খাবেনা। ছোট বাচ্চাদের আমি এমনিতেই সহজে বশীভূত করতে পারি, নিশাতকে পারলাম না। বকুনি দিলাম, ভয় দেখালাম। ফলাফল, আমাকে দেখলেই চোখ-মুখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে থাকতো।যখন রক্ত পরীক্ষার জন্য তুলতুলে নরম হাতটাকে ফুটা করা হতো, দু’চোখ বেয়ে যেন মুক্তোর দানা পড়তো। ওর সাথে মজা করে কথা বলতে লাগলাম, একতরফাভাবে। আস্তে আস্তে আমার সাথে সহজ হতে লাগলো………।

একদিন সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সিদ্ধান্ত হলো নিশাতকে অপারেশন টেবিলে শোওয়াতে হবে।

ছোট্ট মেয়ের নরম শরীরে ধারালো ছুরির স্পর্শ লাগলো।দুইদিন শুধু আমার সাথে না, ওর মায়ের সাথেই কথা বললো না অভিমান করে।আমদের সিস্টার-রা খেলনা কিনে কিনে ওর বিছানা ভরিয়ে দিলো।মুখটা আবার হাসিতে ভরে উঠলো।সারা ওয়ার্ড মাতিয়ে রাখলো প্রাণবন্ত সজীবতায়। ধীরে ধীরে সে হাটা শুরু করলো, যেদিন সম্পূর্ণ একা একা হাটতে পারলো-মনে হলো এভারেষ্টের চূড়ায় সে উঠে গেছে, সমগ্র পৃথিবী তার পদানত। অবশেষে একদিন হাসপাতাল থেকে নিশাতের ছুটি হলো, গাড়িতে যখন যাচ্ছিল দূর থেকে ওর হাসি মাখা মুখ দেখতে পারছিলাম, আর মনে মনে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম ওকে যাতে হাসপাতালে আর দেখতে না হয়…………।

(নিশাতের কোমরে ক্যান্সার হয়েছিলো, যা ছড়িয়ে পড়েছিলো আশেপাশের টিস্যুতে। আমরা ওকে অপারেশনের পর কেমো/রেডিওথেরাপীর পরামর্শ দিয়েছিলাম।)

গতকাল এক রোগী দেখার জন্য অনকোলজী(ক্যান্সার) বিভাগ থেকে রেফারেল আসলো। একপ্রান্তে শীর্ণ এক ১০ বছরের ছোট্ট মায়াকাড়া মেয়ে। চমকে উঠলাম—এ যে নিশাত! হাত উপরে তোলার শক্তি নেই, কথা বলার ইচ্ছা নেই।ক্যান্সার অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।আস্তে করে ওকে ডাকলাম।মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো, উজ্জ্ব্ল হয়ে উঠলো দু’টো চোখ, হাসিতে ভরে উঠলো মুখ………।

আমার মনটা খুব খারাপ, খু-উ-ব।

কেওয়াইএএমসিএইচ,, ১৮/০৪/২০১১

সন্ধ্যা ৭ টা