লিবিয়ার পথে পথেঃ (৪)

বিমানে ভ্রমন যতোই আরামদায়ক হয়, সেটা যদি হয় এগার ঘন্টার ভ্রমন, কোনোরকম যাত্রা বিরতি ছাড়াই, তাও আবার ইকোনমি ক্লাসে, কোনোভাবেই স্বাচ্ছন্দপূর্ণ হবার কথা নয়। এর উপরে আবার যদি সুন্দরী লিবিয়ান বিমানবালারা ইংরেজী কম জানে, তাহলে তো আরো সমস্যা। তাও সুন্দরী বিমানবালাদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে বলে কিছু সাহায্য পাওয়া যায়, কিন্তু যখন সুন্দর বিমানবালাদের কাছে এক বোতল পানির কথা বললে শুনতে হয়, আপনাদের জন্য এক বোতলই বরাদ্দ এবং সেটা দেওয়া হয়ে গেছে, তখন মনে হয়েছিলো, ‘হা হুতোম্মি! এ যাচ্ছি কোথায়?’

এমনিতেই আমাদের যাত্রা ছিলো রাতে, তার উপরে এই রকম অভ্যর্থনা, লিসাকে দেখলাম খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লো। বিপদে পরলাম আমি। আমি হচ্ছি নিশাচর, এগার ঘন্টা বসে বসে ঘুমানোটা আমার জন্য একরকম অসম্ভব ব্যাপারই। জেগে রইলাম আমি। এই জেগে থাকার জন্যই হয়তোবা শুনতে পেলাম তার ফোঁপানো কান্না!

আমাদের থেকে দুই আসন সামনে বসা। এক সিষ্টার। প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে যাচ্ছে। সেটাও কান্নার উপলক্ষ্য নয়, তার তিন বছরের একমাত্র ছেলেকে বাংলাদেশে রেখে আসতে হয়েছে, এটাই একমাত্র কারণ। মনে হলো, আমি যাচ্ছি হয়তোবা অভিজ্ঞতার জন্য অথবা ঘুরে বেড়ানোর জন্য, অর্থনৈতিক ব্যাপারটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু এইসব সিষ্টারদের কাছে সেটাই প্রধান কারণ। লিবিয়া সরকারের এই চাকরী পাবার জন্য এজেন্সিতে তাদের জমা দিতে হয়েছে এক লাখ টাকার উপরে, যেখানে সরকারী থেকে নির্দিষ্ট করা ছিলো মাত্র পয়ত্রিশ হাজার টাকা। তাও এরা কোনো উচ্চবাচ্য করেনি, স্বপ্ন দেখেছে লিবিয়াতে গিয়েই অল্প কয়েক মাসের ভিতরেই টাকা তুলে ফেলবে, তারপর শুরু করবে সঞ্চয়। একসময় বিপুল টাকা নিয়ে দেশে ফিরে এসে সংসারকে সুন্দর করে সাজাবে, সন্তানকে ভালোভাবে বড়ো করবে। এর জন্য কত কষ্ট! তিন বছরের ছেলেকে ছাড়া থাকার কতো যন্ত্রনা! এইসব কথা চিন্তা করতে করতে কখন যেনো দুই চোখের পাতা এক হয়ে গেলো বুঝতেই পারি নি।

সচকিত হয়ে উঠলাম বিমানবালার আরবী উচ্চারনে ‘Good Morning’ শুনে, সকালের নাস্তা নিয়ে এসেছে। পাশ থেকে লিসা উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘দেখো, দেখো! নীলাকাশ!’ আমার চোখ লিসাকে অতিক্রম করে জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেলো। যদিও বিমানের পাখির মতো ডানাটা খুব সমস্যা করছিলো, তারপরো নীল আকাশের নীচে সাদা মেঘের ভেলা দেখে আমি যেনো থমকে গেলাম। ভাগ্যিস আমি কবি নই! তাহলে এই একটা বিষয় নিয়েই কবিতা লিখে আমি বাংলাদেশের সব কবিদের পিছনে ফেলে দিতাম! তাই মুগ্ধ নয়নে শুধু চেয়ে থাকলাম।

পাশ থেকে লিসা উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘দেখো, দেখো! নীলাকাশ!’

কিছুক্ষন পরে ঘোষনা দেওয়া হলো সীটবেল্ট বাঁধার জন্য, আর অল্প সময় পরেই আফ্রিকিয়া এয়ারলাইন্সের বিশাল A330- এয়ারবাসটি ত্রিপলী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে। আমাদের সবার ভিতর একটা সাজ সাজ রব শুরু হলো, সাথে এক উদ্বেগ! পরিচিত পরিবেশের সবকিছু ছেড়ে নতুন অপরিচিত পরিবেশে আসার উদ্বেগ! আমাদেরকে বলা হলো, এয়ারপোর্টের বাইরের তাপমাত্রা ১৪°- এর মতো। আমরা সবাই গরম কাপড় গায়ে দিয়ে বিমান থেকে নামলাম, পা দিলাম লিবিয়ার মাটিতে, আফ্রিকা মহাদেশে!

ত্রিপলী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (ছবি গুগল থেকে সংগৃহিত)

ত্রিপলী এয়ারপোর্ট লিবিয়ার সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট। ত্রিপলী থেকে ৩৪ কিলোমিটার দক্ষিনে বেন ঘাসির নামক জায়গায় এটি অবস্থিত। এই এয়ারপোর্টে লিবিয়ান এয়ারলাইন্স, আফ্রিকিয়া এয়ারওয়েজ এবং বোরাক এয়ারের হেড কোয়ার্টার অবস্থিত। বোরাক এয়ার হচ্ছে লিবিয়ার প্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানী, লিবিয়ান সিভিল ওয়ারের জন্য ২০১১ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ত্রিপলী বিমানবন্দরটি খুব বেশি বড়ো নয়। একটি মাত্র প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল। ঘরোয়া এবং ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটসমূহের জন্য চেক-ইন এবং এরাইভাল (Arrival) ফ্যাসিলিটিজ একই বিল্ডিং-এ অবস্থিত, তবে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। পাঁচ তলা এই ভবনটি ৩৩,০০০ বর্গ মিটার এলাকার উপর তৈরী হয়েছে। এখানে দিনরাত ২৪ ঘন্টা কাজ চললেও যাত্রীদের রাতে থাকার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। চার তলাতে একটি মাত্র রেস্টুরেন্ট আছে। এমিরেটসের বিজনেস ক্লাসের জন্য একটা এবং ইকোনমি ক্লাসের জন্য একটা লাউঞ্জ এবং প্রায় বাকী সব এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাসের জন্য আরেকটি লাউঞ্জের সুব্যবস্থা আছে।

লম্বা করিডোর দিয়ে যখন ইমিগ্রেশনের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন দেখি এয়ারপোর্টের ভিতরেই প্রকাশ্যে কিছু কর্মকর্তা (পোশাক দেখে তাই মনে হলো) সিগারেট টানছে, এবং সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ভিতরেই ফেলছে! আমরা যখন এয়ারপোর্টে নামি, তার একটু পরে ইউরোপ থেকে আরেকটি ফ্লাইট আসে। ইমিগ্রেশনের লাল দাগের বাইরে আমরা অপেক্ষাতেই থাকি, আর সেই ইউরোপীয় ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জাররা এসে আগে আগে চলে যায়। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌছলাম, আমাদের ফ্লাইট বাংলাদেশ থেকে এসেছে বলে এই বিশেষ সংবর্ধনা!

অবশেষে সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আমরা এয়ারপোর্টের বাইরে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এলাম। আসলে আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, তাদেরকে এক ব্যক্তি পাসপোর্টে সিল দেবার সময়ই বলে দিয়েছিলো কোথায় যেতে হবে। আমরা জানতাম, এয়ারপোর্ট থেকে হেলথ মিনিস্ট্রির লোক এসে আমাদের সবাইকে হোটেলে নিয়ে যাবে, সেখানে দুই-তিনদিন থাকতে হবে, এরপর সরকারীভাবে আমাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হবে, আমরা সেইসব জায়গায় চলে যাবো। আর যারা স্বামী এবং স্ত্রী দুইজনেই এসেছে (আমাদের ফ্লাইটে আমরাসহ আর মাত্র একটি পরিবার ছিলো), তারা একই হাসপাতালে পোস্টিং পাবে।

নির্দিষ্ট জায়গায় এসে আমরা হেলথ মিনিষ্ট্রির এমন তিনজন লোককে পেলাম, যারা একদমই ইংরেজী জানে না (পরে দেখেছি- লিবিয়ার সরকারী অফিসগুলোর বেশিরভাগ লোকই ইংরেজী জানে না!)। তারা ইশারায় আমাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিচ্ছে, আর নাম দেখে (পাসপোর্টে আরবী ট্রান্সক্রিপশন ছিলো) এয়ারপোর্টের বাইরে দন্ডায়মান আট – নয়টি বিশেষ গাড়ির মধ্যে যার যার নির্দিষ্ট গাড়িতে উঠতে বলছে। আমাদের সাথে থাকা এক সিস্টার, যিনি এর আগে সৌদি আরবে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন, ভালো আরবী বলতে জানে, সে ঐ তিন লোকের সাথে কথা বলে আমাদেরকে যা জানালো, তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না! এয়ারপোর্ট থেকেই না কি যার যার হাসপাতালের এলাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি যখন আমার পাসপোর্ট দিলাম, আমাকে একটা প্রাইভেট কার দেখিয়ে দিলো। আট – নয়টি গাড়ির মধ্যে একমাত্র সেটাই প্রাইভেট কার এবং আমি জানতে পারলাম আমার পোস্টিং গারিয়ান টিচিং হাসপাতালে, ত্রিপলি থেকে আশি কিলোমিটার দক্ষিনে আর লিসার পোস্টিং আমার এলাকা থেকে প্রায় ১৪০০ মাইল দূরের বেনগাজী, লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে!

লিবিয়ার পথে পথেঃ২

আমার জন্য লিবিয়ায় যাওয়াটাই ছিলো এক অদ্ভুত ব্যাপার। একদিন পত্রিকায় লিবিয়ান স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে ডাক্তার নেবার বিজ্ঞপ্তি দেখে অনেকটা খেয়াল বশেই আমি আর লিসা ঢাকার হোটেল ইশা খাঁতে ভাইভা দিতে গিয়েছিলাম। ভাইভা নেবার জন্য লিবিয়ান স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের তিনজন কর্মকর্তাও ঢাকায় এসেছিলেন। ভাইভাতে মেডিকেল জ্ঞান সংক্রান্ত তেমন কোনো প্রশ্ন করা হলো না। তারা আমাদের কাগজপত্র দেখলেন। কিছু টুকটাক প্রশ্ন করলেন। আমরাও কিছু জিনিস জানতে চাইলাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বেতন নির্ধারন নিয়ে। মাছের বাজারে গিয়ে মাছ কেনার অভিজ্ঞতা না থাকলেও কীভাবে যেনো সেদিন মাছের বাজারের মতোই দরদাম করেছিলাম, চিন্তা করলে আজো অবাক লাগে! শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো মেডিসিনের মেডিকেল অফিসার হিসেবে লিসা এবং নিউরোসার্জারীর রেজিস্ট্রার হিসেবে আমি যোগদান করবো।

আমরা চাকরী ফাইনাল করে ফেললাম, কিন্তু যেতে পারবো কী না তখনো সেটা নিশ্চিত ছিলাম না। কারণ, আমরা জানতাম, আব্বু কখনোই আমাদেরকে দেশের বাইরে যেতে দিবেন না। সত্য কথা বলতে গেলে, লিবিয়ার ব্যাপারটা আব্বুকে বলারই সাহস পাচ্ছিলাম না। এভাবে প্রায় এক মাস চলে গেলো। ভিসার জন্য আমরা পাসপোর্টও জমা দিয়ে ফেললাম, অথচ তখনো আব্বু কিছুই জানতেন না।

লিবিয়াতে কেনো যেতে চাচ্ছিলাম সেটা এক বিশাল ব্যাপার। কারণ, ভাইভা পরীক্ষা দিয়েছিলাম শুধুমাত্র খেয়ালের বশে। চিন্তা করেছিলাম, ভাইভাতে চান্স পেলেও যাবো না। ঠিক এই সময়ে এডহকের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার ডাক্তার নিয়োগ দেবার ঘোষনা দেন প্রধানমন্ত্রী। আব্বুর ইচ্ছা ছিলো যাতে আমরা এডহকে যোগদান করি। এই ব্যাপারে উনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ওবায়দুল কাদের এবং শেখ ফজলে নুর তাপসের সাথে কথাও বলেছিলেন। আসলে এডহকের নিয়োগ ছিলো রাজনৈতিক, যতোই সেটা সরকার অস্বীকার করুক। এডহকের সময় প্রতিটি মেডিকেল কলেজ থেকে কয়েকটা লিস্ট করা হয়। সক্রিয় আওয়ামী পন্থী, মধ্যপন্থী (এদের ভিতরে ছিলো যারা দুর্বলভাবে বিএনপি করতো, এবং অন্যান্য বামপন্থী), কালো তালিকাভুক্ত (এই গ্রপে ছিলো জামায়াত শিবিরের সমর্থকরা এবং যারা সক্রিয়ভাবে ছাত্রদল বা বিএনপি করতো) এবং দলমত নিরপেক্ষ। তালিকার বাইরে ছিলো তদবিরকারীদের দল। আমার মেডিকেল কলেজের সিনিয়ররা আমাকে কোন তালিকাভুক্ত করেছিলো, আমি জানতাম না, আসলে জানার চেষ্টাও করি নি। দুই একদিন স্বাচিপ অফিসে গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে স্বার্থান্বেষীদের ভীড় দেখে পরে আর যেতে ইচ্ছে করলো না। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম নিজের কিছু ব্যাচমেটদের আচরণ দেখে। সদ্য গজিয়ে উঠা এই সব লীগ পন্থীদের মধ্যে আমি অনেককেই জানতাম যারা বিএনপির আদর্শের অনুসারী। এডহক নিয়ে যে নোংরা খেলা শুরু হয়েছিলো, আমাদের এডহকে নিয়োগ নিশ্চিত জেনেও আমি খুব হতাশ ছিলাম।

লিবিয়ার ভাইভা দিয়ে আসার পর আমি লিবিয়ার সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম। প্রাচীন কিছু সভ্যতার কেন্দ্র, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এই দেশ সম্পর্কে যতই জানতে থাকলাম, ততই মুগ্ধ হতে লাগলাম। আর্কিওলজিকাল দিক থেকে লিবিয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটা দেশ। ছোটবেলা থেকেই এইসব ব্যাপারে আমার প্রচন্ড একটা ঝোঁক ছিলো। ক্রমেই লিবিয়া যাওয়ার ব্যাপারে আমি ও লিসা উৎসাহী হয়ে উঠি। সর্বোপরি, বেতনের পরিমানটাও ছিলো আমাদের লিবিয়া যাওয়ার ব্যাপারে প্রধান একটা কারণ।

অবশেষে, সিদ্ধান্ত নিলাম আব্বুকে জানাবো। আমি তখন ঢাকার বাইরে থাকতাম। সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারী বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সেখানে ভালোই ছিলাম। আমরা কয়েকজন তরুন ডাক্তার একযোগে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল থেকে এসে সেখানে নিউরোসার্জারী বিভাগ চালু করেছিলাম। ঠিক করলাম, পরবর্তী সপ্তাহে ঢাকায় গিয়ে আব্বুর সাথে কথা বলে লিবিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাবো। আব্বুর প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম।

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। ঢাকায় যাবার দুইদিন আগে এক প্রচন্ড ব্যস্ত দুপুরে, লাঞ্চের সময় আমার ছোট বোন ফোন করে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো আব্বু আর এই পৃ্থিবীতে নেই! সকালে স্বরাষ্ট্রসচিবের সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগদানের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে এসে করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মেঝেতে পড়ে যান। সামনের দরজাতে মাথায় আঘাত লেগে রক্তপাতও শুরু হয়। দ্রুত নিকটবর্তী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষনা করেন। তাঁর একমাত্র ছেলে আমি ডাক্তার হয়েও তাঁর জন্য কিছুই করার কোনো সুযোগ পেলাম না। আমাকে এই বিশাল পৃ্থিবীতে সম্পূর্ণ একা রেখে উনি আম্মুর সাথে দেখা করতে চলে গেলেন!

আব্বুর মৃত্যুর পর আনুষঙ্গি্ক কাজগুলো সারতে প্রায় একমাস হয়ে গেলো। এই সময় জানলাম আমাদের লিবিয়ায় যাওয়ার ভিসা হয়ে গেছে। যে কথা আমরা আব্বুকে জানাতে ভয় পাচ্ছিলাম, আল্লাহ আমাদেরকে সেই কথা তাঁকে জানাতেই দিলেন না। হয়তো আল্লাহ চেয়েছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আব্বু যাতে জেনে যেতে পারেন তাঁর ছেলে তাঁর পাশেই আছেন। লিবিয়ার ফ্লাইটের আগের দিন হোটেল শেরাটনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাদের হাতে লিবিয়ার ভিসাসহ পাসপোর্ট তুলে দিলেন। এডহকের ভাইভার আগের দিনই ছিলো আমাদের ফ্লাইটের তারিখ!


বামেঃ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগতম জানাচ্ছে লিসা, পাশে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সচিব
ডানেঃ মন্ত্রীর কাছ হতে পাসপোর্ট নিচ্ছি আমি

লিবিয়ার পথে পথে

বেশকিছু দিন যাবত কোনো কিছুই লিখতে পারি নি। প্রফেশনাল ব্যস্ততা ও অন্যান্য আরো কিছু কারণে সময় বের করে নেটেও বসা হয় নি। আজ যখন ল্যাপটপ খোলার একটু সময় পেলাম, পুরানো ছবিগুলো দেখতে দেখতে উপরের ছবিটি দেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম।

ছবিটি আমি যখন লিবিয়াতে কর্মরত ছিলাম, তখনকার তোলা। সবার বামে আছেন ইউক্রেনিয়ান ইউরোলজিস্ট ডাঃ ইউরি, এরপর বাংলাদেশের ডাঃ নিয়াজ (আমি, আর কী!), রুমানিয়ান জেনারেল সার্জন (নাম মনে করতে পারছি না), সুদানীজ জেনারেল সার্জন (উনার নামও মনে করতে পারছি না, আমার স্মরণশক্তি যে এতো খারাপ হয়ে গেছে, আমি আগে বুঝতে পারি নি, রীতিমত আতংকের ব্যাপার!) এবং সবশেষে লিবিয়ান জেনারেল সার্জন ডাঃ আলী। ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা! সাদা, কালো এবং নিগ্রো! কিন্তু সবাই আমরা মানুষ, মানুষ এবং মানুষ!

আমি ছিলাম গারিয়ান টিচিং হাসপাতালের স্পেশালিস্ট নিউরোসার্জন। গারিয়ান শহরটি আমাদের দেশের বান্দরবনের মতো, এক বিশাল পর্বতশ্রেণির গা বেয়ে উঠে যেতে হয়। পর্বতশ্রেণিটি নাফুসা মাউন্টেন রেঞ্জ নামে পরিচিত। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলী থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত নাফুসা মাউন্টেন এরিয়া লিবিয়ান সিভিল ওয়ারে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা রেখেছে। অনেক কাল থেকেই নাফুসা মাউন্টেন এরিয়া লিবিয়ার উপজাতি মানুষদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিলো, কিন্তু গাদ্দাফীর শাসনামলে তাদের এই বৈশিষ্ট্য চাপা পড়ে, তাই যখন গণ আন্দোলন শুরু হয়, প্রথম থেকেই এই এলাকার জনসাধারণ বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়। ১৮ই আগষ্ট, ২০১১-তে বিদ্রোহী বাহিনী যখন গারিয়ান দখল করে, ত্রিপলী দখল করা তখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ত্রিপলীর পতন ঘটে ২৩ আগষ্ট, ২০১১।

নাফুসা মাউন্টেন রেঞ্জ

গারিয়ান টিচিং হাসপাতাল একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিলো। হাসপাতাল এরিয়াটি ছিলো বিশাল বড়ো। পর্বতশ্রেণির গা বেয়ে যখন আমাদেরকে নিয়ে (ওহ হো, বলাই হয় নি, লিবিয়াতে আমি একা যায় নি, আমার পিছু পিছু আমার অর্ধাঙ্গিনীও তাড়া করেছিলো) লিবিয়ান ড্রাইভার প্রাইভেট কারটাকে ঝড়ের গতিতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, আমি ভয় পাচ্ছিলাম না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলাম আর বাংলায় চিৎকার করে বলছিলাম, ‘অসাধারণ! আমি মুগ্ধ!’ লিবিয়ান ড্রাইভারটি আমার দিকে তাকিয়ে আরবিতে কী বললো, বুঝতে পারি নি, শুধু বুঝতে পেরেছি সেও আমার উচ্ছ্বাসের সাথে উচ্ছ্বসিত!

গারিয়ান শহরটিকে দেখে আমাদের খুব ভালো লেগে গেলো। বাংলাদেশের মফস্বল শহরের মতো, কিন্তু ছিম ছাম, সাজানো-গোছানো। পুরো নাফুসা মাউন্টেন রেঞ্জের লোক সংখ্যা চার লক্ষের বেশি হবে না, গারিয়ানে সেটা এক লক্ষের মতো। অথচ শহরটা আয়তনে প্রায় ঢাকার সমান। পাহাড় গুলোর মাঝে দিয়ে মসৃন রাস্তা দিয়ে যখন আমরা সাঁ সাঁ করে যাচ্ছিলাম, কেনো জানি না, অসম্ভব ভালো লাগায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলো। গাড়ির স্পীডোমিটারে গতি তাই ১৩০ পার হয়ে গেলেও মনে হচ্ছিল আরেকটু জোরে গেলে ক্ষতি কী!

আমাদের ড্রাইভার মহাশয়টি ইংরেজী জানে না, আর আমরা আরবী জানি না। আমি আজও অবাক হয়ে যাই, কীভাবে ত্রিপলী এয়ারপোর্ট থেকে গারিয়ান হাসপাতাল পর্যন্ত এক ঘন্টার জার্নিতে আমরা একসাথে এসেছিলাম! হোক সে আরবীভাষী, হোক আমি বাঙ্গালি, হোক সে সাদা আর হোক আমি কালো, আমরা মানুষতো! পথে সে যখন গাড়ি থামিয়ে একাকী একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলো, স্বীকার করছি, তখন কিন্তু মনে হয় নি সে মানুষ! আমি আর আমার স্ত্রী তখন গাড়িতে বসে দোয়া দরুদ পড়ছিলাম, আর ভাবছিলাম সে সত্যিতো গারিয়ান হাসপাতালের ড্রাইভার! একটু পরে যখন দুই হাতে দুইটা নেসক্যাফের গ্লাস কফি ভর্তি করে নিয়ে এসে বত্রিশখানা দাঁত বের করে আমাদের দুই জনকে দিলো, তখন মনে হলো, এই পৃ্থিবীতে তার চেয়ে আর ভালো মানুষ হয় না।

একটু পরে বুঝতে পারলাম, সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী জানে, যেমন, My name Yakub. I am fine. Your Name?- এই রকমের ভাঙ্গা ইংরেজীতেই সে আমাদেরকে জানালো, আগামী বছর সে বিয়ে করবে, একজন ইউক্রেনিয়ানকে। ছবিও দেখালো, মেডিটারিয়ান সাগরের তীরে তোলা সেই ছবি দেখে আমার স্ত্রী একটু লজ্জাই পেয়ে গেলো। কিন্তু লোকটির সরলতা দেখে লিসার লজ্জা পেতেই লজ্জা লাগছিলো! ওহ হো, লিসা কে তা তো বুঝতে পারছেন, তাই না? লিসা হচ্ছে আমার তিনি! ড্রাইভার যখন লিসার নাম শুনে বার বার লিজা লিজা বলছিলো, তখন কিছুটা বিব্রত হয়ে গেলাম। কিন্তু তার সরল হাসি দেখে কিছুক্ষন পরে আমি নিজেই লিজা লিজা ডাকা শুরু করলাম।

অবশেষে হাসপাতাল কম্পাউন্ডের ভিতরে প্রবেশ করলাম। প্রথম দেখাতেই এই বিশাল হাসপাতালকে খুব ভালো লেগে গেলো। হাসপাতালের প্রবেশ পথেই বিলবোর্ডে গাদ্দাফীর বিশাল এক ছবি দেখলাম, যা প্রায় পুরো রাস্তাতেই কিছু পর পর ছিলো। ছবিতে সানগ্লাস পরিহিত গাদ্দাফীর পাশে আরবীতে কী লেখা ছিলো সেটা বুঝতে না পারলেও বড় করে ইংরেজীতে লেখা 40- এর জন্যই বুঝতে পারছিলাম এই বছর গাদ্দাফীর শাসনের চল্লিশ বছর পূর্তি হচ্ছে।

গারিয়ান টিচিং হাসপাতালের সামনে চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে গাদ্দাফীর বিশাল বিলবোর্ড

এই ২০১১-তে গাদ্দাফীর 42 বছর পূর্ণ হতো। সবগুলো বিলবোর্ডে 40 এর জায়গায় 42 লেখা ছিলো। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ১৯৬৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রাজা ইদ্রিসের কাছ থেকে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের বিয়াল্লিশ বছর পূর্ণ হবার আগেই, ২০১১ সালের ২৩শে আগস্ট গাদ্দাফী নিজেই ক্ষমতা হারালেন!