মানুষের জীবনে একবার যদি চিকেন পক্স হয়, তাহলে নাকি পরবর্তীতে আর হবে না। সে হিসেবে আমার বোধহয় আর চিকেন পক্স হবার কথা নয়। কারণ এই দুর্বিষহ রোগটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার এক মাস আগেই হয়েছিলো কিন্তু শরীরে রেখে গেয়েছিলো এর চিহ্ন, বিশেষ করে মাথায়। তাই সুস্থ হবার পরই আমার অসম্ভব প্রিয় কেশরাজিকে বিসর্জন দিয়ে বেলতলায় যাওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ করে ফেলেছিলাম। এমতাবস্থায়ই মেডিকেল কলেজে পদার্পন আমার।
তাই ওরিয়েন্টশন ক্লাসে যখন শিফা আমাকে মুন্ডিত মস্তক নিয়ে প্রশ্ন করলো, আমি প্রস্তুত ছিলাম। ওয়ালেট থেকে কেশযুক্ত পূর্বেকার ছবি দেখিয়ে বললাম, “আমি আদপে দেখতে খুব একটা খারাপ নই”। ফলাফল হলো ভয়াবহ। এরপর যে কারো সাথে দেখা হলেই, সে হোক সিনিয়র অথবা ক্লাসমেট, প্রথমেই আমার ওয়ালেটের ছবির কথা জিজ্ঞেস করতো।
ওরিয়েন্টশন ক্লাসে আমার পাশে বসেছিলো মনোয়ার, সিলেটে বাড়ি। যখন ওর সাথে কথা বলছিলাম, কোথ্থেকে যেন কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল জামসেদ স্যার এসে আমাকে জানিয়ে গেলেন নতুন ছাত্রদের পক্ষ থেকে কিছু বলতে হবে। আমার এতবড়ো সর্বনাশটা কে করেছিলো আমি আজও তা জানতে পারিনি। ওরিয়েন্টশন ক্লাস শেষে আমাদেরকে যখন কলেজ এবং হাসপাতাল পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, শিফা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি বিতার্কিক কিনা? কথাটা শুনে যতটা না অবাক হচ্ছিলাম, তার চেয়ে বেশী কুকড়ে যাচ্ছিলাম সব সহপাঠীদের তীর্যক চক্ষুবানে। (আমি আসলেই শাহীন স্কুল, ঢাকার ডিবেট ক্লাবের প্রতিস্ঠাতা সদস্য ছিলাম।)
প্রথম যখন এনাটমি ডিসেকশন রুমে ডেড বডি দেখি, যাকে বলা হয় ক্যাডাভার, গা শিরশির করে উঠেছিলো। জামশেদ স্যার আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলেছিলেন, এই ডেড বডিই আমাদের পরবর্তী সময়ের সার্বক্ষনিক সঙ্গী। এর রুপ, রস, গন্ধ, স্বাদ কোনোকিছুকেই আমরা আর কখনো এড়াতে পারবো না। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে স্যারের কথাকে ধ্রুব সত্য বলেই মনে হচ্ছে।
যখন আমরা লাইব্রেরীতে গেলাম, স্যার বলে যাচ্ছেন, মেডিকেল কলেজগুলোতে একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রিডিং পার্টনারসহ লাইব্রেরীতে পড়া। পাশ থেকে মৃদু কন্ঠে কে যেন বলে উঠল, রিডিং পার্টনার থেকে লাইফ পার্টনার। আমার সহপাঠীদের তীর্যক চক্ষুবান আমি অনুভব করতে পারলাম, পার্থক্য একটাই, এবার শিফারও আমার মতো অবস্থা হলো।
বিকেলে আমরা নতুন বন্ধুরা মিলে গল্প করছিলাম। যেখানে আমি সেখানে শিফার প্রসংগ আসবেই। যারা একবছর ড্রপ দিয়ে ভর্তি হয়েছে তারা বুঝালো আমি শিফার চেয়ে ছোট, বাকীরা অন্যদেরকে মনে করিয়ে দিলো গতরাতের সিনিয়রদের সতর্ক-বার্তা।
বেশ কিছুদিন পর।
শিফার সাথে আমার চেয়েও মনোয়ারের ঘনিস্ঠ্তা আমরা সবাই উপলদ্ধি করতে পারছিলাম। প্রতিদিন বিকেল বেলায় ক্যান্টিনে, লেকের পাড়ে ওদেরকে গল্পে-মশগুল দেখা যেত। একদিন সন্ধ্যার পর ওর রুমে গিয়ে দেখি, মনোয়ার উদাস দৃষ্টিতে সিলিং-এর ফ্যানের দিকে তাকিয়ে মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর মনোয়ার নিরবতা ভঙ্গ করলো, “শিফা বিবাহিত”।
(মেডিকেল কলেজের সময়কাল নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি আমার বন্ধুদের খুব করে miss করছি, বিশেষ করে ফয়েজ, মনোয়ার, মাসুদসহ আরো অনেককে। ওদের প্রতি আমার প্রচন্ড মুগ্ধতা আমি এই সুযোগে জানাতে চাই। ভালো কথা, মনোয়ার কিন্তু আজও পর্যন্ত স্বীকার করেনি যে শিফাকে পছন্দ করতো, অবশ্য খুব ভালো বন্ধু ছিলো, এখনো আছে। ও সেদিন কষ্ট পেয়েছিলো, শিফা যে বিবাহিত সেটা দেরীতে জানার জন্য।)