শুরু হলো পথচলা… (আমার মেডিকেল কলেজ জীবন-২)

মানুষের জীবনে একবার যদি চিকেন পক্স হয়, তাহলে নাকি পরবর্তীতে আর হবে না। সে হিসেবে আমার বোধহয় আর চিকেন পক্স হবার কথা নয়। কারণ এই দুর্বিষহ রোগটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার এক মাস আগেই হয়েছিলো কিন্তু শরীরে রেখে গেয়েছিলো এর চিহ্ন, বিশেষ করে মাথায়। তাই সুস্থ হবার পরই আমার অসম্ভব প্রিয় কেশরাজিকে বিসর্জন দিয়ে বেলতলায় যাওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ করে ফেলেছিলাম। এমতাবস্থায়ই মেডিকেল কলেজে পদার্পন আমার।

তাই ওরিয়েন্টশন ক্লাসে যখন শিফা আমাকে মুন্ডিত মস্তক নিয়ে প্রশ্ন করলো, আমি প্রস্তুত ছিলাম। ওয়ালেট থেকে কেশযুক্ত পূর্বেকার ছবি দেখিয়ে বললাম, “আমি আদপে দেখতে খুব একটা খারাপ নই”। ফলাফল হলো ভয়াবহ। এরপর যে কারো সাথে দেখা হলেই, সে হোক সিনিয়র অথবা ক্লাসমেট, প্রথমেই আমার ওয়ালেটের ছবির কথা জিজ্ঞেস করতো।

ওরিয়েন্টশন ক্লাসে আমার পাশে বসেছিলো মনোয়ার, সিলেটে বাড়ি। যখন ওর সাথে কথা বলছিলাম, কোথ্থেকে যেন কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল জামসেদ স্যার এসে আমাকে জানিয়ে গেলেন নতুন ছাত্রদের পক্ষ থেকে কিছু বলতে হবে। আমার এতবড়ো সর্বনাশটা কে করেছিলো আমি আজও তা জানতে পারিনি। ওরিয়েন্টশন ক্লাস শেষে আমাদেরকে যখন কলেজ এবং হাসপাতাল পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, শিফা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি বিতার্কিক কিনা? কথাটা শুনে যতটা না অবাক হচ্ছিলাম, তার চেয়ে বেশী কুকড়ে যাচ্ছিলাম সব সহপাঠীদের তীর্যক চক্ষুবানে। (আমি আসলেই শাহীন স্কুল, ঢাকার ডিবেট ক্লাবের প্রতিস্ঠাতা সদস্য ছিলাম।)

প্রথম যখন এনাটমি ডিসেকশন রুমে ডেড বডি দেখি, যাকে বলা হয় ক্যাডাভার, গা শিরশির করে উঠেছিলো। জামশেদ স্যার আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলেছিলেন, এই ডেড বডিই আমাদের পরবর্তী সময়ের সার্বক্ষনিক সঙ্গী। এর রুপ, রস, গন্ধ, স্বাদ কোনোকিছুকেই আমরা আর কখনো এড়াতে পারবো না। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে স্যারের কথাকে ধ্রুব সত্য বলেই মনে হচ্ছে।

যখন আমরা লাইব্রেরীতে গেলাম, স্যার বলে যাচ্ছেন, মেডিকেল কলেজগুলোতে একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রিডিং পার্টনারসহ লাইব্রেরীতে পড়া। পাশ থেকে মৃদু কন্ঠে কে যেন বলে উঠল, রিডিং পার্টনার থেকে লাইফ পার্টনার। আমার সহপাঠীদের তীর্যক চক্ষুবান আমি অনুভব করতে পারলাম, পার্থক্য একটাই, এবার শিফারও আমার মতো অবস্থা হলো।

বিকেলে আমরা নতুন বন্ধুরা মিলে গল্প করছিলাম। যেখানে আমি সেখানে শিফার প্রসংগ আসবেই। যারা একবছর ড্রপ দিয়ে ভর্তি হয়েছে তারা বুঝালো আমি শিফার চেয়ে ছোট, বাকীরা অন্যদেরকে মনে করিয়ে দিলো গতরাতের সিনিয়রদের সতর্ক-বার্তা।

বেশ কিছুদিন পর।

শিফার সাথে আমার চেয়েও মনোয়ারের ঘনিস্ঠ্তা আমরা সবাই উপলদ্ধি করতে পারছিলাম। প্রতিদিন বিকেল বেলায় ক্যান্টিনে, লেকের পাড়ে ওদেরকে গল্পে-মশগুল দেখা যেত। একদিন সন্ধ্যার পর ওর রুমে গিয়ে দেখি, মনোয়ার উদাস দৃষ্টিতে সিলিং-এর ফ্যানের দিকে তাকিয়ে মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর মনোয়ার নিরবতা ভঙ্গ করলো, “শিফা বিবাহিত”।

(মেডিকেল কলেজের সময়কাল নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি আমার বন্ধুদের খুব করে miss করছি, বিশেষ করে ফয়েজ, মনোয়ার, মাসুদসহ আরো অনেককে। ওদের প্রতি আমার প্রচন্ড মুগ্ধতা আমি এই সুযোগে জানাতে চাই। ভালো কথা, মনোয়ার কিন্তু আজও পর্যন্ত স্বীকার করেনি যে শিফাকে পছন্দ করতো, অবশ্য খুব ভালো বন্ধু ছিলো, এখনো আছে। ও সেদিন কষ্ট পেয়েছিলো, শিফা যে বিবাহিত সেটা দেরীতে জানার জন্য।)

মেডিকেল কলেজের প্রথম দিন……

অনেকক্ষন ধরে আমি ওকে লক্ষ্য করছিলাম। নারীদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের বর্ণনা আমি কখনই দিতে পারি না, সে চেষ্টাও তাই করবো না। মেডিকেল কলেজে প্রথম দিন এসে আমার এই সহপাঠিনীকে দেখে আগামী পাঁচটা বছর খুব কম সময় মনে হচ্ছিল। কিভাবে কথা বলা শুরু করা যায় চিন্তা করছিলাম। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! হঠাৎ দেখি সে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে!! আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলাম কিনা বুঝতে পারছিলাম না!!!

আমার মেডিকেল কলেজের প্রথম দিন। ভর্তি হয়েছিলাম জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে। আমার বাবা-মা দুজনেই তখন দেশের বাইরে। সকালবেলা যখন আমার ছোট বোন আর খালার সাথে ঢাকার কমলাপুর স্টেশন হতে এগারসিন্দুর ট্রেনে উঠে বসি তখনও ভাবিনি এত সুন্দর ক্যাম্পাসে আসবো। দুপুর একটায় বাজিতপুরে নেমে যখন কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকলাম, আমার মনটা জুড়িয়ে গেলো। আমি যেন এক সবুজের সমারোহের মধ্যে চলে আসলাম।

আমার ক্যাম্পাস, আমার ভালোবাসা

অফিসে ঢুকতে গিয়েই দেখি আরো কয়েকজনের মতো সে-ও অপেক্ষা করছে। আমার মন তখন বাক-বাকুম করছিল কি না জানি না, শুধু মনে আছি সম্বিত ফিরে পেলাম ওর কথায়, “আমি শিফা, তুমি?” আমার নামটা মনে হয় ঠিকঠাকমতোও বলতে পারিনি তখন, চোখের সামনে রঙ্গিলার ঊর্মিলাই ভাসছিল।

অফিসের কাজ শেষ করে হোস্টেলে আসলাম। আমার প্রথম হোস্টেল জীবন, প্রথম রুম নম্বর ১০৮ আর প্রথম রুমমেট ফয়েজ। ফয়েজ-সেও ঢাকা থেকে আসা, প্রথম দেখাতেই ভালো লাগা ( অবশ্যই শিফার মতো নয়)। আমার বোন আর খালাকে বিকালের ট্রেনে বিদায় দিয়ে যখন রুমে আসি, ফয়েজের প্রথম কথাই ছিলো আমার কাজিনের সাথে আমার সম্পর্ক কত দিনের। অনেক কষ্টে বোঝাতে পারলাম সে আমার আদরের আপন ছোট বোন (পরে জানতে পারলাম প্রথম ছয় মাস ফয়েজ আমার কথা বিশ্বাসই করেনি)।

আছরের নামাযের কিছু আগে আমাদের রুমে এক কিম্ভুতকিমাকার ছেলে ঢুকলো, তার কথাবার্তার কিছুই ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না, খুব ছটফটে, সে বাংলাই ঠিকমতো বলতে পারছিল না। খুব ভয় পেয়ে গেলাম, ভাবলাম সব সিনিয়র ভাইরা যদি এরকম হয়, তাহলে খবরই আছে। হঠাৎ করে সে বলল, চল নামায পড়তে যাই। বড় ভাইয়ের কথা, ফেলা বড় দায়, তাও আবার প্রথম দিন?

হোস্টেলের মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে দেখি সেই বড় ভাই নেই। নামায শেষ করে যেই বের হবো-শুনলাম আজ গ্রাস্তের দিন, অতএব চরম ক্লান্তি সত্ত্বেও মাগরিব পর্যন্ত মসজিদে থাকতে হলো। মনে মনে সেই বড় ভাইয়ের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছিলাম।

রাতে একব্যাচ সিনিয়র ভাইয়েরা আমাদের সবাইকে তাঁদের একজনের রুমে ডাকলো, আমাদের সাথে নাকি পরিচিত হবে। সেখানে গিয়ে দেখি, বিকালের সেই বড় ভাই দাঁড়িয়ে বলছে, “ আমি আশিক, আমেরিকা থেকে এসেছি”(আমেরিকান-বাংলাদেশী, ফরেন কোটায় পড়তে এসেছিলো)। আমি পারলে তখন ওকে কাগজের টুকরার মতো ছিঁড়ে ফেলি।

আমাদের পরিচয়ের পালা শেষ হবার পর একজন ভাইয়া বললো, “তোমাদের সাথে আমার এক বান্ধবী ভর্তি হয়েছে, এক বছর ড্রপ দিয়ে”। আমরা সবাই বুঝতে পারলাম-এটা একটা সতর্কবার্তা, যাতে সেই মেয়েটার কাছে কেউ প্রেমপত্র না দেয়।

আমাদের অনেকেই একটু নড়াচড়া করে ঠিকমতো বসলো। আর আমার মাথায় আশিককে কিভাবে শায়েস্তা করবো সে চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। হঠাৎ করে শুনতে পেলাম ভাইয়া মেয়েটার নাম বলছে, “শিফা”!