গত কিছুদিন যাবত তাঁকে খুব অস্থির লাগছে। উনি সপ্তাহের শুরুতে কুমিল্লায় চলে যান, শেষের দিন ঢাকায় বাসাতে আসেন, যেখানে সপ্তাহজুড়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকে তাঁর স্ত্রী আর সন্তানেরা। এমনিতেই উনি খুব রাশভারী স্বভাবের লোক, তাঁর ছেলে মেয়েরা তাঁকে খুব যমের মতো ভয় পায়। তাঁর স্ত্রী হয়তোবা অতটা ভয় পান না, তবে খুব একটা ঘাঁটানোর চেষ্টা করেন না। তারা সবাই বুঝতে পারছে তাঁর কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কি হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস এখনও অর্জিত হয় নি।
কিন্তু আজ রাতে খাবার টেবিলে উনি নিজে থেকেই বলতে লাগলেন। উনি শুরু করলেন এভাবে, ‘আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা তোমাদেরকে বলবো। তোমরা শুধু শুনবে, কোনো কথা বলবে না বা কোনো পরামর্শ দিবে না। ব্যাপারটা হলো………..’
(২)
আমাদের সবচেয়ে ছোট বোনটা, যার নাম নাবিলা, সবসময় বলে সে হচ্ছে বড় লোকের মেয়ে, আমার ইমিডিয়েট ছোট বোন নিশাত হচ্ছে মধ্যবিত্তের মেয়ে আর আমি হচ্ছি সবচেয়ে গরীবের ছেলে! আমি যখন জন্ম গ্রহন করি তখন বাবা ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নিশাত যখন এই পৃথিবীতে আসলো বাবা তখন একজন জুনিয়র আইনজীবি, নাবিলা যখন ভূমিষ্ঠ হয়ে জীবনে প্রথম বারের মতো কাঁদলো তখন বাবা জেলা ও দায়রা জজ।
আমি ছাত্রের ছেলে হলেও যখন থেকে বুঝতে শুরু করি, তখন থেকেই বাবাকে বিচারক হিসেবেই দেখে এসেছিলাম। উনি প্রতিদিন সকালবেলা সময় মতো অফিসে যেতেন, দুপুরে বাসায় এসে খেয়ে আবার অফিসে যেতেন, এবার আসতেন বিকেল বেলায়। তারপর সারাক্ষন বাসায় থাকতেন, কোথাও যেতেন না, টিভি দেখে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরতেন। মাঝে মাঝে কোনো দিন তাঁর কোনো সহকর্মী বা অন্য ক্যাডারের কোনো অফিসারের বাসায় মা-কে নিয়ে বেড়াতে যেতেন।
একদম ছোটবেলা থেকেই আমার এবং নিশাতের চলাফেরার ক্ষেত্রটা উনি সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। আমরা বাইরের কারো সাথে সহজে মিশতে পারতাম না। এমনকি বন্ধু নির্বাচনও করতে হতো সতর্কভাবে। ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে যখন পড়ি, একদিন রাতের খাবার সময় আমাদেরকে বলেছিলেন আমরা কখনোই যেনো কোনো অফিসিয়াল ব্যাপারে তাঁকে কিছু না বলি বা অনুরোধ না করি।
যখন আরেকটু বড় হলাম, কখনো সখনো স্কুল থেকে সোজা বাবার অফিসে চলে যেতাম। বাবা আমাকে চেম্বারে বসিয়ে রেখে কালো গাউন পরে এজলাসে উঠতেন। আমি চেম্বার আর এজলাসের সংযোগকারী দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখতাম উনি বিশাল একটা চেয়ারে বসে আছেন, যে চেয়ারে দাড়িপাল্লার ছবি খোঁদাই করা থাকতো। দেখতে পেতাম আরেকজন কালো গাউন পরা লোক একটি প্রকোষ্ঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি লোককে জেরা করছে। শুনতে পেতাম…………..। এভাবেই অনেক কিছু দেখেছিলাম, অনেক কিছু শুনেছিলাম………….।
বিভিন্ন জেলা ঘুরে বাবা যখন ঢাকায় পোস্টিং পেলো, আমরা ঢাকায় জেঁকে বসলাম। এক সময় বাবার ট্রান্সফার হলো কিন্তু এবার ঢাকা আমাদের ছাড়লো না বা আমরা ঢাকাকে ছাড়লাম না। আমারও আর চেম্বার ও এজলাসের সংযোগকারী দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে কোনো কিছু দেখা হলো না, শোনা হলো না।
(৩)
বাবা কুমিল্লাতে নারী ও শিশু নির্যাতন বিশেষ আদালতের বিচারক ছিলেন। সেখানে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই এমন একটি মামলার শুনানি শুনতে লাগলেন যেটা পরবর্তীতে তাঁকে প্রচন্ড রকম অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দেয়।
একমাত্র ছেলে। অল্প বয়সে বাবা মারা যাবার পর মা খুব কষ্ট করে ছেলেকে বড় করেছে, এজন্য মা-কে বিভিন্ন বাড়িতে ঝি-এর কাজও করতে হয়েছে। এক সময় ছেলে সুন্দরী দেখে এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনলো। মা ভাবলো এবার বুঝি তার অন্যের বাড়িতে ঝি-গিরি শেষ হবে। অন্যের বাড়িতে ঝি-গিরি ঠিকই শেষ হলো, কিন্তু নিজের বাড়িতেই সে ঝি থেকে গেলো। যে মা ছেলেকে কষ্ট করে বড় করলো, সেই ছেলে তার সেই মাকে তার স্ত্রীর সামনে অনবরত ছোট করতে লাগলো। ব্যাপারটা বোধহয় উপরওয়ালা্র ভালো লাগেনি। ছেলেটি এক দুর্ঘটনায় চলৎ শক্তি হারিয়ে ফেলে। অথর্বের মতো সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতো। তার সুন্দরী স্ত্রীর এসব ভালো লাগেনি কি না জানি না, সে তার বাবার বাড়িতে চলে গেলো। কিছুদিন পর অন্যত্র বিয়েও হয়ে গেলো। আবার সেই ছেলে আর সেই মা। মা-তো মা-ই। সে তাঁর ছেলেকে ফেলে কোথাও যেতে পারলো না। ছেলের জন্য রান্না করা, বিছানা মল-মূত্র দিয়ে অপরিষ্কার করলে তা পরিষ্কার করা, ছেলের শরীর মুছে দেওয়া—সব, সব কাজ সেই মা চরম মমতায় করতো। এরপরও কোনো কাজ করতে একটু দেরী হলেই ছেলের মুখ থেকে অশ্রাব্য গালি গালাজ বের হওয়াটা কমতো না।
একদিন সে বিছানা মল ত্যাগ করে নষ্ট করে দিলো। চিৎকার দিয়ে মা-কে ডাকলো, মা এক প্রতিবেশীর সাথে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। ঐ অবস্থায় বললেন একটু পরে আসছেন। ছেলে ছ্যাচড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে, সেই একই ভাবে রান্নাঘরে গিয়ে, দাও (বটি) নিয়ে এসে আবার বিছানাতে আসলো। কিছুক্ষন পর মা যখন ছেলের কাছে এসে দাঁড়ালো, ছেলে দাও টা মায়ের দিকে ছুড়ে দিলো, মা-কে এই কষ্টকর জীবন থেকে চিরমুক্তি দিলো।
মামলার শুনানিতে ছেলেটি কখনোই মা-কে ইচ্ছে করে হত্যা করার কথা স্বীকার করেনি, সবসময় বলে এসেছে দুর্ঘটনা্য় হাত থেকে দাও ছুটে গিয়ে গায়ে লাগায় মা মারা গেছে। এমনকি এই হত্যাকান্ডের কোনো চাক্ষুস স্বাক্ষীও পাওয়া যায় নি। কিন্তু ঘটনা পরম্পরা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ছেলের পূর্বের ব্যবহার সবকিছু বিচার বিশ্লেষন করে বাবার মনে হয়েছিলো ছেলেটি ইচ্ছাকৃ্ত ভাবেই খুনটি করেছে, চাচ্ছিলেন ছেলেটিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে। কিন্তু নিরেট প্রমানের অভাবে বার বার হোঁচট খাচ্ছিলেন। একবার তাঁর মনে হওয়া শুরু করলো সত্যিই এটা একটা দুর্ঘটনা। উনি চাচ্ছেন মৃত্যুদন্ড দিতে, আবার ভাবছেন এটা দুর্ঘটনা নয়তো? হয়তো ছেলেটা বাস্তবিকই নিরপরাধ। আবার যখনই মনে পরছে ছেলে মা-কে হত্যা করেছে, তখন আবার ফুঁসে উঠছেন। ফুঁসে উঠছেন পুলিশের প্রতি, ফুঁসে উঠছেন আইনজীবিদের প্রতি, কেনো তারা অকাট্য প্রমান দেখাতে পারছে না।
আমার বাবাকে আমি কখনই এতটা অসহায় দেখেনি। তিনি সেদিন রাতে খাবারের সময় পুরো ঘটনাটা বলে আমাদেরকে বললেন, ‘আমি জানি না আমি কি করবো। নিজের মনকে প্রাধন্য দিবো, না কি প্রমানের ভিত্তিতেই রায় দিবো?’
(৪)
সেই ঘটনার প্রায় তিন বছর চলে গেলো। আমরা বাবাকে আর জিজ্ঞেস করিনি তিনি কি রায় দিয়েছিলেন, তিনিও আমাদেরকে বলেন নি। বাবা তখন মুন্সীগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ। একদিন অফিস থেকে বাসায় আসলেন মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। মা-কে বললেন, ‘আজ আমার বুকের উপর দিয়ে বিশাল ভারী একটা পাথর সরে গেলো। হাই কোর্ট আমার রায়টাকে বহাল রেখেছে’।
আমরা তখনই জানতে পারলাম বাবা সেই ছেলেটিকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ঝোলানোর আদেশ দিয়েছিলেন।