একটি প্রতিবাদলিপি

( আমার লেখা ‘এ লজ্জা রাখি কোথায় ?’ আমি মুক্তব্লগে পোস্ট করেছিলাম। সেখানে জনৈক জিল্লুর রহমান আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমন করে একটা পোস্ট লিখেছে। আমার এই লেখা সেটার প্রতিবাদ)

আমাকে নিয়ে আপনার খুব সুন্দর লেখাটি আমার কিছুক্ষন আগে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা পড়ে। আমি জানি না আপনি কি করেন তবে ডাক্তারদের নিয়ে যে আপনি চিন্তা করেছেন জেনে খুব খুশি লাগছে।

সঙ্গত কারণেই আপনার লেখার সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। তাই কিছু লিখতে চাচ্ছি। আপনি কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত।

১।দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এদেশের গরীব-দূঃখী মানুষের ট্যাক্সের টাকায় চালিত হয় সুতরাং গ্রামের মানুষের সেবার প্রতি আপনার মানসিকতা আমাকে অবাক করেছে।
—- আমি আমার লেখার কোথাও বলেছি কি না গ্রামের মানুষদের আমরা সেবা করতে চাই না? যদি আপনি দেখাতে পারেন কোথাও এই কথা আমি লিখেছি, আমি ব্লগিং ছেড়ে দিবো। লেখা সম্পূর্ণ না পড়ে, না বুঝে একটা কথা লিখে দিলেই হলো না। আপনি বলেছেন, “পাঁচ বছর যাদের টাকায় লেখাপড়া শিখবেন এক বছর তাদের সেবা করতে আপনার এত আপত্তি কোথায়?” আপনি যদি কথাটি আমাকেই উদ্দেশ্য করে বলেন, তাহলেও বলবো আপনি আমার লেখা পড়েন নি। আমি পরিষ্কার ভাবে লিখেছিলাম আমি বেসরকারী মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলাম, দেশের গরীব-দূঃখী মানুষের ট্যাক্সের টাকায় আমি পড়েনি, আমি পড়েছি আমার বাবার কষ্টার্জিত উপার্জনের টাকায়। জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ সরকার থেকে কোনো টাকা পেতো কি না আমি জানি না, তবে আমার ইন্টার্নীর টাকাও দেশের গরীব-দূঃখী মানুষের কাছ হতে পাই নি, পেয়েছি WHO হতে। বলা উচিৎ নয়, এরপরও বলছি, মেডিকেলে পড়তে আমার প্রায় দশ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে, আমার টাকা ফেরত দেওয়া উচিৎ, না কি আমাকে টাকা ফেরত দেওয়া উচিৎ?

২। গ্রামে আপনার শিক্ষাজীবনে শেখাবার ডাক্তার নেই একথাটা পাঠক সাধারনকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছেন এটা ঠিক না কারণ প্রত্যেক উপজেলা সদরে একজন টি.এইচ.এ এবং কয়েকজন এম.বি.বি.এস ডাক্তার ছাড়াও ইদানিং বিশেষজ্ঞ আছে তাদের কাছে আপনার শেখার অনেক আছে।———- খুবই হাসি পাচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রামের কথা বাদ দিলাম, থানা পর্যায়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি অবস্থায় আছে সেটা বোধহয় আপনি ছাড়া আর সবাই জানে, অতএব বোকা বানানোর প্রশ্নই আসে না। বরং আপনার লেখা দিয়ে আপনি বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন। আপনি কি জানেন থানা পর্যায়ে কি ঘটে? আপনাকে কিছু নমুনা দিচ্ছি-আমার এক পরিচিত আপুর পোস্টিং হলো কুমিল্লার দেবীদ্বারে।সে প্রথম দিন গিয়ে দেখলো যে সেখানে ব্যবস্থা হচ্ছে রুগী আসলে ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি টিকিটে দেখাবেন না প্রেস্ক্রিপ্সন করাবেন?” টিকিট মানে সরকারী ৩ টাকার টিকিট, আর প্রেসক্রিপশন মানে ১০০/২০০ টাকা দিয়ে দেখানো। নিয়ম অনুসারে সরকারী কোন কমপ্লেক্সে টাকা নেয়া ম্যালপ্রাক্সিস এবং অনৈতিক। আপু বললেন, আমি টাকা ছাড়া রুগী দেখবো, যে কাজে আমি এসেছি। ৬ দিন টিকতে পারলেন, ৭ম দিন টিএইচও(অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পোস্ট) আপুকে ডেকে পাঠালেন। সরাসরি বললেন, আপনি সপ্তাহে ১ দিন আসবেন। আপনার রোজ আসার দরকার নেই। বেতন তোলার দিন বেতন তুলে নিবেন। প্রতিদিন যেন আপনাকে না দেখি।

আরেকজন এরকম টাকা নিতে অস্মকৃতি জানানোয় একদিন গিয়ে দেখেন তার রুমে তালা মারা। টিএইচও বললেন, রুমে তালা মারার অর্থ আপনার বুঝা উচিত।

এদের কাছ হতে শিক্ষানবীশ ডাক্তাররা কি শিখবে? আর এই যে এডহকে ৫০০০ ডাক্তার নিলো, কয়জন ডাক্তার গ্রামে আছে? আমার কথাই ছিলো সেই টা, আমরা সরকারী ডাক্তারদের গ্রামে পাঠাতে পারছি না, এখন চাচ্ছি ইন্টার্নী ডাক্তারদের পাঠাতে। আমার প্রতিবাদ ছিলো এই খানে।

৩। মানবসেবা শব্দটাই আমার কাছে এখন হাস্যকর লাগে-এটা ঠিক বলেছেন সেবা যখন কবরেনই না তখন আর সেবকের কৃতিত্ব নিতে চাইবেন কেন?———- এবার একটু কড়া ভাবেই আমি বলতে চাই আপনার লেখা বোঝার কোনো ক্ষমতাই নেই। মানবসেবা আমি করি কি না সেটা আমিই জানি, আপনি নন। আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন? আমি কি করি সে টা আপনাকে বলতে যাওয়াটা আমার বোকামী হবে, শুধু এটুকু বলতে পারি আপনার বোঝার সামর্থ্য নেই কতটুকু কষ্টে এই কথাটা লিখেছিলাম। আপনার উপরোক্ত কথা দ্বারা আবার বোঝা যাচ্ছে আপনি আমার লেখাই পড়েন নি।

৪। ডাক্তাররা যেন গ্রামের হাসপাতালে গিয়ে ঠিকমতো ডিউটি করে সেজন্য ইন্টর্নী কালীন সময় তাদের হাজিরা ইউ.এন.ও দের হাতে দিয়ে তাদের হাতে যেন কিছু মার্ক দেয়া হয় যাতে ডাক্তাররা স্টেশনে থাকতে বাধ্য হয় তা না হলে ইন্টার্নী ডাক্তাররা যাদের তত্বাবধানে থাকবে তারা স্বজনপ্রীতি করবে। ———— হা হা হা…। আপনি আমাকে বলেছেন আমি উন্নত প্রজাতির প্রাণী (মানুষও নই), আর আপনাকে আমি কি বলবো? আপনি কি ভাই ইউ এন ও? কিছু বাড়তি টাকা কামাতে চাচ্ছেন? আমি এই বিষয়ে আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।

৫। ডাক্তাদের পড়াশোনার সময় আরো বৃদ্ধি করে হিউম্যান ডেভলাপম্যাণ্ট ট্রেনিং দেয়া উচিত।
————- হ্যাঁ, এখানে আমি আপনার সাথে একমত। তবে আপনার লেখার টোনটা ছিল ব্যাঙ্গাত্নক এবং আমার পোষ্টের বিষয়বস্তু থেকে আলাদা/অপ্রাসংগিক।

৬। ডাক্তারদের উপস্থিতি এবং জনসেবার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেক উপজেলায় স্থানীয় সরকার কিংবা ইউ.এন.ওদের সমন্বয়ে কমিটি করা উচিত যাতে তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে (সেবা না দায়িত্ব)।
————— আমি আবারও বলবো আপনি আমার লেখা পড়েননি। আমার লেখার বিষয়বস্তু ছিলো ইন্টার্নী ডাক্তারদের গ্রামে এক বছর ইন্টার্নী করা নিয়ে, ডাক্তারদের ব্যাপারে আমি কিছুই বলি নি। আপনার কথা পুরোপুরি অপ্রাসংগিক।

৭। ডাক্তাররা নিরীহ মানুষদের অযথা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করে যেন ডায়গোনিস্টিক সেণ্টার থেকে কমিশন না নিতে পারে সেজন্য তদারকি করা দরকার। —————- আমার পোষ্টের বিষয়বস্তু থেকে আলাদা/অপ্রাসংগিক।

৮। অপারেশনে কোন রোগী মারা গেলে তার সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যাসহ তার গাফিলতির জন্য রোগী মারা গেলে তার শাস্তির বিধান থাকা উচিত।—————-আমার পোষ্টের বিষয়বস্তু থেকে আলাদা/অপ্রাসংগিক।

৯। যে কোন সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক কোন মামলা করতে গেলে যে সরকারের অনুমতি দরকার এটা ডাক্তারদের বেলায় প্রযোজ্য করা ঠিক হবে না।—————আমার পোষ্টের বিষয়বস্তু থেকে আলাদা/অপ্রাসংগিক।

আপনি আপনার কোনো অভিমত থাকলে আপনি সে টা বলতেই পারেন, কিন্তু আপনি আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমন করে পোষ্টের শিরোনাম দিয়েছেন, যে টা ভদ্রতার কোনো সীমারেখার মধ্যেই পরে না। হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং আপনারও নেওয়া উচিৎ।

সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই, কোনো লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গেলে লেখাটা পুরোপুরি পড়ে, এর অর্থ বুঝে তারপরে কলম ধরুন, তার আগে নয়।

আমি সাধারণত কখনোই এভাবে আক্রমনাত্নক লেখা লিখি না, এবার লিখলাম, আপনার লেখাটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে বলে। ভালো থাকুন অবিরত।

এই লজ্জা রাখি কোথায়? (প্রসংঙ্গঃ ইন্টার্নী ডাক্তারদের গ্রামে এক বছর ইন্টার্নী করতে হবে)

সরকারের প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে ডাক্তার সমাজে বিশেষ করে ভবিষ্যত ইন্টার্নী ডাক্তারদের মধ্যে তুমুল আলোচনা চলছে। তাদের আলোচনার বিষয় প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যনীতির একটি প্রস্তাব নিয়ে, যেটাতে বলা হয়েছে ইন্টার্নী ডাক্তাররা পাঁচ বছরের শিক্ষা শেষ করে আরো দুই বছর ইন্টার্নী করবে, প্রথম এক বছর নিজ শিক্ষা প্রতিস্ঠানে, পরবর্তী বছর গ্রামে গিয়ে। এবং শুধুমাত্র তারপরই একজন ইন্টার্নী ডাক্তার BM & DC-এর সনদপত্র পাবে। আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থানে প্রস্তাবটি কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?

আমি এই আলোচনায় কোনো সংখ্যাগত পরিসংখ্যানে যাবো না বা গুরুগম্ভীর আলোচনাও করতে চাইনা, একজন ডাক্তার হিসেবে নিজের কিছু অনুভূতির কথা বলতে চাচ্ছি।

আমি যখন ক্লাস সিক্স/সেভেনে পড়তাম, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় যারা মেধাতালিকায় স্থান পেতো, পত্র-পত্রিকায় তাদের অধিকাংশই বলতো ভবিষ্যতে ডাক্তার হবে, মানবসেবা করবে। সেই সময় এই ডাক্তার হতে চাওয়ার একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো, কেনো তা জানি না। তখনো আমি ডাক্তার হতে চাইনি।

যখন আরেকটু বড় হলাম, অনেককে বলতে শুনতাম বাংলাদেশের ডাক্তাররা কিছুই জানে না, তারা একেকজন এক একটা কসাই। একটু অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরা চিকিৎসার জন্য দেশের ডাক্তারদের উপর নির্ভর না করে পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যেতো। তখনো আমি ডাক্তার হতে চাইনি।

আমার এইচএসসি-এর সময় আমার মায়ের যখন ক্যান্সার ধরা পড়লো এবং ডাক্তাররা যখন বললো উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যেতে হবে তখনো আমি ডাক্তার হতে চাইনি।

এরপরও আমাকে মেডিকেলে ভর্তি হতে হয়েছে আমার কালো গাউন পরার স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আমরা কেউ ভর্তি হলাম মেডিকেলে, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ, আবার কেউবা অন্য বিষয়ে। আমি যখন মেডিকেলে ভর্তি হলাম তখন নিয়ম ছিলো ইন্টার্নী হবে এক বছরের, ছয় মাস মেডিসিনে আর ছয় মাস সার্জারী অথবা গাইনীতে এবং ইন্টার্নী শেষে পোস্টগ্রাজুয়েশন-এর জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং-এর ছয় মাস গননা করা হবে। আমাদের ইন্টার্নী শুরু হতে হতে নিয়ম হয়ে গেলো ইন্টার্নী হবে এক বছরের কিন্তু সবাইকে চার মাস করে মেডিসিন, সার্জারী এবং গাইনী করতে হবে আর এই ইন্টার্নশীপ সময় পোস্টগ্রাজুয়েশন-এর জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং হিসেবে গন্য হবে না।

যেহেতু বেসরকারী মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলাম, বাবার লাখ লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ বছরের পড়াশোনা শেষে মাসিক মাত্র পাঁচ হাজার টাকার বেতনে ইন্টার্নী শুরু করলাম। (সরকারী মেডিকেলে লাখ লাখ টাকা খরচ না হলেও সেটা যে খুব যৎসামান্য তাও নয়।) মনে আছে, ইন্টার্নীর সময় আমাদের ব্যাচের ছয় বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা একটি ম্যাগাজিন বের করবো, এ্যাডের জন্য ঢাকার সিটিসেল অফিসে গিয়ে স্কুল ফ্রেন্ডের সাথে দেখা, এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে আছে। অফিস শেষে দেখলাম নিজের প্রাইভেট কারে উঠে আমাকে বলছে কোথায় যাবি, লিফট দিতে পারি।

আমি হয়তোবা ভালো ছাত্র ছিলাম, তাই ইন্টার্নীসহ ছয় বছরের মধ্যেই নামের শেষে এমবিবিএস শব্দটা বসাতে পেরেছিলাম। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ সে সুযোগ পেলোনা, তাদের প্রতীক্ষার প্রহর আরো বাড়লো। ইন্টার্নী শেষ করে শুনতে পেলাম, আগে ছিলাম খালে, এবার এসে পড়েছি মহাসমুদ্রে। কারো কাছে এমবিবিএসের কোনো মূল্য নাই, মূল্য পেতে চাই নামের সাথে আরো কিছু শব্দ। ঢাকাতে হাসপাতালগুলোতে চাকরী করতে এসে দেখি বেতন বার/তের হাজার টাকার বেশী না। কেউ কেউ বলবেন ডাক্তারতো হয়েছি মানবসেবার জন্য, টাকার জন্য নয়। মানবসেবা?

মানবসেবা শব্দটাই আমার কাছে এখন হাস্যকর লাগে। আমার চাকরীজীবন শুরু হয়েছিলো ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতাল দিয়ে (সঙ্গত কারণেই নামটা বলছি না)। আমি সেখানে ডাক্তার ছিলাম না কেরানী পদে ছিলাম, তা নিয়ে আমার এখনো সন্দেহ আছে। জ্বরের জন্য একটা প্যারাসিটামল দিতে হলেও আমাকে সিনিয়র কোনো ডাক্তারকে আগে জানাতে হবে, মনে হচ্ছিল ছয়টা বছর বৃথাই ডাক্তারী পড়েছি। একবার এক বড় মাপের ব্যক্তির (ঢাকার নির্বাচিত এক সাবেক মেয়র) বড় ছেলে তার বাবা কেনো অন্যান্ন দিনের চাইতে আজ বেশী তন্দ্রাচ্ছন্ন, কি কি ওষুধ পাচ্ছে তার একটা লিস্ট আমি কেনো কনস্যাল্ট্যান্টের অনুমতি ছাড়া দিতে পারবো না সেজন্য আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ফেললো। আরেকজন ব্যক্তি (ঢাকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরের স্বামী)কেনো আমি তার রোগীনী স্ত্রীকে জ্বর ক’বার এসেছে জিজ্ঞেস করেছি বলে আমার চাকরিই শেষ করে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছিলো, ঠিক একই সময়ে যখন দেখি আমার ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধুর পিছনে বহু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, যখন দেখি আমার আর্মির কর্নেল বন্ধুর বিশাল সুযোগ সুবিধা, যখন দেখি আমার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু বিশাল ব্যবসা করছে, তখন আমার কবরবাসিনী মায়ের উপর প্রচন্ড অভিমান হয়, তাঁর ইচ্ছার জন্যই যে এই পেশায় আসতে হলো।

এই সময় আমার এক সিনিয়র ভাইয়া বিসিএস পরীক্ষায় চান্স পেয়ে থানাতে পোস্টিং পেলো।(বাংলাদেশে না কি রোগী অনুপাতে ডাক্তার কম, গ্রাম বা থানা পর্যায়ে আরো কম, তাহলে আমি একটা জিনিস বুঝি না একজন ডাক্তারকে ছয় বছর সেই বিষয়ে পড়াশোনা করার পর কেনো তাকে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া লাগবে? এমনিতেই কি সে সরকারী চাকরী পাবার যোগ্য নয়?) তাঁর কাছ হতে শুনতে পারলাম সে তাঁর থানায় মাসে দুই একবার যায়। প্রথম দিকে সে থানা হেলথ কমপ্লেক্সে বসে রোগী দেখতো, প্রাইভেটলি নয়, ফলাফল থানায় থাকতে না পারা।

আমি লিখতে বসেছি ইন্টার্নী ডাক্তারদের সময়সীমা দুই বছর করা নিয়ে (তন্মধ্যে গ্রামে এক বছর), অথচ সেখানে আমার কাসুন্দী গেয়ে যাচ্ছি, আমার আসলে নির্ধারিত আলোচনায় আসা উচিৎ।

আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে ইন্টার্নীশীপ দুই বছর কেনো? কেনো একজন ডাক্তারকে সাত বছর সময় ব্যয় করতে হবে শুধুমাত্র এমবিবিএসের জন্য যে ডিগ্রীর কোনো দামই নেই এখন? বাংলাদেশে সবচেয়ে recognised postgraduation degree হচ্ছে FCPS, MS আর MD। আমরা ডাক্তাররাই জানি এই ডিগ্রীগুলো পেতে কত বছর সময় লাগে। এমনিতেই ডাক্তারী পেশায় আজীবন পড়াশোনার মধ্যেই থাকতে হয়, তারপরও অফিসিয়ালী যদি পনের/বিশ বছর লেগে যায়, সে ডাক্তার তথাকথিত মানবসেবা কখন করবে? যেখানে তার অন্যান্ন পেশার বন্ধুরা ভালো অবস্থায় আছে।

ইন্টার্নীদের গ্রামে কেনো এক বছর করতে হবে? আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা যাদেরকে ভোট দিয়ে সংসদে বা সরকারে পাঠাই, তাঁরা হয় কিছুই বুঝেন না বা না বোঝার ভান করেন। একটা complete health system-এ শুধুমাত্র একজন এমবিবিএস ডাক্তার নয়, আরো কয়েকজনের উপস্থিতির প্রয়োজন আছে। According to WHO প্রতি একজন এমবিবিএস ডাক্তারের কাজে সাহায্য করার জন্য প্রায় ৯ প্যারামেডিক বা প্যারা প্রফেশনাল ক্যাডারের লোক লাগে, যেমন, নার্স, প্যারামেডিক্স , ল্যাবরেটরি কিংবা হেলথ এসিস্টেন্ট ইত্যাদি। সর্বোপরি একুইপমেন্টাল সাপোর্ট। গ্রামে বা থানা (এমনকি জেলা) পর্যায়ে এই ধরনের সম্পূর্ণ সাপোর্ট কি আছে? একজন ইন্টার্ন ডাক্তার মানে সে শিখছে। গ্রামে সে কার কাছ হতে শিখবে? তাকে গাইড করবে কে? একজন ইন্টার্নীকে উপযুক্ত গাইড ছাড়া গ্রামে পাঠানো তো গ্রামের লোকদের সাথেই প্রতারণা করা। আমাদের সরকার পারছে না তার নিয়োগকৃ্ত সরকারী ডাক্তারদেরই গ্রামে রাখতে, সে সরকার কিভাবে আশা করে একজন ইন্টার্নীকে গ্রামে রাখবে? (সরকারী মেডিকেল কলেজের ব্যপারে না হয় বলা যায়, কিন্তু বেসরকারী মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রে?) গ্রামে চিকিৎসা সেবা ছড়িয়ে দিতে হবে, ঠিক আছে, কিন্তু যেখানে আমরা পারছি না এডহকের মাধ্যমে নিয়োগকৃ্ত প্রায় পাঁচ হাজার ডাক্তারের গ্রামে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে (মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর উপুর্যুপরি হুমকী সত্ত্বেও), সেখানে ইন্টার্নী ডাক্তার নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। গ্রামে চিকিৎসা সেবা ছড়িয়ে দিতে গিয়ে গ্রামের মানুষদের সাথে প্রতারণা করছি শিক্ষানবীশ ডাক্তারকে গ্রামে যেতে বাধ্য করে। বাকী যে ৯ ক্যাটাগরির লোক লাগবে তাদের ব্যাপারে আমাদের সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কোনো চিন্তা নেই! হায় সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশের মাথামোটা ব্যক্তিসমৃদ্ধ সরকার!

গ্রামে ইন্টার্নী না করলে সনদ না দেবার ভয় দেখানো হচ্ছে, খুবই অবাক হচ্ছি, সাথে আতংকিতও হচ্ছি। এই ছেলে মেয়েগুলো গ্রামে থাকবে কোথায়, খাবে কোথায়, শোবে কোথায়, নিরাপত্তা দেবে কে-কোনো কিছুরই আমরা সুস্ঠু সমাধান না দিয়ে স্বাস্থ্যনীতির খসড়া করে বসে আছি।

আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ে পড়ছে ঢাকা কেন্দ্রিক। একে বিকেন্দ্রীকরন করতে হলে কিছু যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো গাইড (নিদেনপক্ষে কনস্যাল্ট্যান্ট লেবেলের কোনো ডাক্তার) ছাড়া, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ছাড়া, প্রয়োজনীয় লোকবল ছাড়া এবং সুগঠিত অবকাঠামো ছাড়া ইন্টার্নী ডাক্তারদের গ্রামে পাঠানোর মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক হাততালি হয়তোবা পাওয়া যাবে, কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরন আর হবে না। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও সরকারী ডাক্তারদের গ্রামে না পাঠাতে পেরে আমরা এখন ইন্টার্নী ডাক্তারদের উপযুক্ত প্রস্তুতি না নিয়ে মহাসমুদ্রে না, মহাবিশ্বে ফেলে দিচ্ছি। এই লজ্জা রাখি কোথায়?