দিপুর গল্প

দিপু যেনো বিশ্বাসই করতে পারছিলো না! আজ এই পরিস্থিতিতে সে সন্ধ্যাকে দেখবে কখনো চিন্তাই করেনি। সন্ধ্যাও দিপুকে দেখে চমকে উঠলো। মুহূর্তটা ফ্রিজ হয়ে থাকলো কিছুক্ষন। দিপুই প্রথম প্রকৃতিস্থ হলো। সন্ধ্যাকে এড়িয়ে ইমার্জেন্সী মেডিকেল অফিসারকে জিজ্ঞেস করলো রোগীর আত্নীয় স্বজন কেউ আছে কি না।

“আমিই রোগীর স্ত্রী,” সামনে এগিয়ে এসে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো সন্ধ্যা। দিপুর কাছে মনে হলো কন্ঠটা কী একটু কেঁপে উঠলো! সেই পরিচিত কন্ঠস্বর! বহুদিনের পরিচিত! “প্রায় দুই ঘন্টা আগে কথা কথা বলতে বলতেই হঠাৎ করে খিচুনী শুরু হয়। এক দুই মিনিটের মতো ছিলো, এরপর বমি করলো,” জানালো সন্ধ্যা।

দিপু রোগীর দিকে তাকালো। বয়সে ওর থেকে কিছুটা বড়ই হবে। দেখতেও সুদর্শন, মায়া মায়া লাগে। পুরুষদের চেহারায় মায়া মায়া ভাবটা মনে হয় থাকা উচিত নয়, সেখানে থাকবে কিছুটা রুক্ষতা! দিপু সেটাই ভাবে। দ্রুত শারীরিক পরীক্ষা করে দেখলো, শরীরের বাম দিক কিছুটা দুর্বল, কথা অবশ্য পরিষ্কার। এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ সজ্ঞানও বটে। দিপু ওর প্রফেসরের সাথে ফোনে কথা বলে এমআরআই ব্রেন করার উপদেশ দিলো।

জায়েদ, সন্ধ্যার স্বামীকে কিছুক্ষনের মধ্যেই এমআরআই রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। কম্পিউটার স্ক্রীনের সামনে বসে রইলো দিপু। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সন্ধ্যাকে নিয়ে তখন দিপুর ভিতরে উথাল পাথাল অবস্থা! ফিরে গেলো যেনো দশ বছর আগের দিনে।

মেডিকেলের প্রথম দিনেই ওদের পরিচয়। প্রতিদিন আড্ডা। তারপর একদিন সন্ধ্যাই ওকে বলেছিলো। এক বিকেলে ফোন করে সন্ধ্যা বললো, “আজ আমি একটা কথা বলবো। বলা শেষ হলেই ফোন রেখে দিবো। তোমাকে কিছু বলতে হবে না! তুমি সেদিন হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম বইটি পড়েছ। সেখানে একটা থিওরী আছে। একজন মানুষের হাতে পাঁচটি নীল পদ্ম থাকে। কেউ যদি এই পাঁচটি নীল পদ্ম একবারেই কাউকে দিয়ে দেয়, তাহলে সে কখনোই তাকে ভুলতে পারে না! আমার হাতে এখন একটিও নীল পদ্ম নেই, সব একসাথে দিয়ে দিয়েছি!” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই সন্ধ্যা ওপাশ থেকে লাইন কেটে দিলো। দিপু হতভম্বের মতো চিন্তা করতে লাগলো সন্ধ্যাতো আগে কখনো ওকে তুমি করে বলতো না!

পরের দিন যখন ক্লাসরুমে দেখা, এক ফাঁকে সন্ধ্যা বিব্রতবোধ করে জানতে চাইলো দিপু কী চিন্তা করছে। দিপু হেসে বলেছিলো, “তুই যে নীল পদ্মগুলো আমাকেই দিয়েছিস, সেটা কিন্তু বলিস নি! কিন্তু আমি নিয়ে নিলাম। আর একটা ব্যাপার, আমি কখনই তোকে তুমি বলতে পারবো না”। সেই থেকে শুরু দুজনার একসাথে পথ চলা।

কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে নিরবতা ভাঙ্গলো দিপুই, “কেমন আছো তুমি?”  সন্ধ্যাও তাকিয়ে আছে স্ক্রীনের দিকে, সেখানে ধীরে ধীরে জায়েদের ব্রেনের ভিতরের ছবি ভেসে উঠছে। সেদিকে তাকিয়েই উৎকন্ঠিত স্বরে সন্ধ্যা জানালো, “ভালো। তুমি কিন্তু আমায় আজ তুমি বললে!” হেসে উঠতে গিয়েও থেমে গেলো দিপু। দৃষ্টি তখন স্ক্রীনে আটকে গেছে। সন্ধ্যাও ডাক্তার, ব্রেনের একটি অংশ দেখিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলো, “এটা কি?”

দিপুর সময় যেনো থমকে গেছে। কোনো উত্তর দিতে পারছে না! মনে হলো বহুকাল পর যেনো বলে উঠলো, “মনে হচ্ছে কোনো বস্তু সেখানে দলা পেকে আছে!” টেকনিশিয়ানকে রঞ্জক পদার্থ দিয়ে প্রতিতুলনা করতে বললো দিপু। সন্ধ্যার বুঝতে আর বাকী রইলো না!

***********

দিপু অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারদের জন্য বিশ্রাম কক্ষে চুপচাপ বসে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। টিক টিক করে সময় বয়ে যাচ্ছে, দিপুর যেনো কোনো সময় যাচ্ছে না। দিপু সন্ধ্যাকে খুব ভালোবাসতো। ওর এখনো স্পষ্ট মনে আছে,  মধুমিতা সিনেমা হলে যখন সন্ধ্যার সাথে টাইটানিক দেখছিলো, ওদের দুটো হাত পরস্পরের সাথে লেগে ছিলো। মনে হচ্ছিলো এ বাঁধন কখনো ছিন্ন হবে না। দিপুর প্রতি সন্ধ্যার ভালোবাসার প্রকাশটা ছিলো উচ্ছ্বল, দিপু সেভাবে প্রকাশ করতে পারতো না। এই প্রকাশ না করাটাই যেনো কাল হলো! একদিন পড়ন্ত বিকেলে রমনা উদ্যানের এক প্রান্তে বসে সন্ধ্যা হঠাৎ করে বলে উঠলো, “তুমি বোধহয় আমাকে খুব একটা ভালোবাসো না”। সেদিন কিছু বলতে পারে নি দিপু। ওর কাছে মনে হয়েছে ভালোবাসাটা দেখানোর কোনো বিষয় নয়, এটা একান্ত মনের ব্যাপার। সেইদিন থেকে যে কী হলো! মেডিকেলের চৌহদ্দি পেরোনোর আগেই দিপু আবিষ্কার করলো, ওদের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা সেই আগের মতো নেই। অথচ কোনো মনোমালিন্য, কোনো সমস্যা কোনোকিছুই ছিলো না। তারপর একদিন দিপু দেখলো সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা তারা হয়ে ও জীবনের আকাশে উঠবে না।

জায়েদের ব্রেন টিউমার হয়েছিলো। ডায়াগনোসিস চূড়ান্ত করার জন্য ওরা অপারেশন করতে চাইলো, যদিও এমআরআই দেখেই মনে হয়েছিলো খুব খারাপ ধরনের টিউমার। দিপুই সন্ধ্যাকে বলেছিলো অপারেশনের আগে যদি জায়েদের কোন কাজ থেকে থাকে, যেসব জায়গায় ওর স্বাক্ষর লাগতে পারে, সেগুলো যাতে করে ফেলে। এবারো দিপুর কথা সন্ধ্যার বুঝতে কষ্ট হয় নি! ওদের একটা ছোট মেয়ে আছে, তিন বছর বয়স হবে। জায়েদকে যখন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসছিলো, দিপু তাকিয়ে ছিলো মেয়েটির চোখের দিকে- কী অদ্ভুত মায়াবী চোখ! মেয়েটি মায়ের চোখ পেয়েছে।

অপারেশনটা খুব জটিল ছিলো। ব্রেনের এমন জায়গায় টিউমারটা ছিলো- জায়গাটা ছিলো রক্তনালীতে পরিপূর্ণ। ওদের উদ্দেশ্যই ছিলো বায়োপসির জন্য যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকুই নিয়ে আসা। একবার ওর প্রফেসর দিপুকে বলেছিলো, ওর কোনো সমস্যা হলে না আসতে। দিপু রাজী হয় নি। অকম্পিত হস্তে মাথার খুলি কেটে যখন ব্রেনে প্রবেশ করলো, অবস্থা ধারণার চেয়েও খারাপ দেখলো । তারপর হঠাৎ করেই এক রক্তনালী কেটে রক্তপাত শুরু হলো……।

পারে নি, দিপু পারে নি জায়েদকে বাঁচাতে। ওর পাঁচ বছরের নিউরোসার্জারীর ক্যারিয়ারে এই প্রথম কোনো রোগী অপারেশনের টেবিলেই মারা গেলো, তাও আবার জায়েদ, সন্ধ্যার স্বামী। ওর প্রফেসর মাথাটা সেলাই করছে এখন, দিপু ওটি থেকে অফ হয়ে এসে একাকী বসে আছে বিশ্রাম কক্ষে। ওর প্রফেসর বললো, দিপু সন্ধ্যাকে জানে, তাই দিপুই খবরটা সন্ধ্যাকে জানাক।

*********

অপারেশন থিয়েটারের বাইরে  সন্ধ্যা আর ওর মেয়েটা অপেক্ষা করছে। দিপু সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলো আনমনে হাসপাতালের রেলিং ধরে খেলা করছে। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেই চোখে একসাথে খেলা করছে আশা আর উদ্বিগ্নতা। সন্ধ্যার চোখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে দিপু কথা বলা শুরু করলো………………।

দিপুকে নিয়ে লেখা আগের গল্পগুলোঃ

ক্যাডাভার

জীবন যেখানে যেমন

একটি আবোল তাবোল গল্প

কাহিনীর বিরতিঃ

সুমিত এই অনুভূতির সাথে পরিচিত। প্রায় এক যুগ আগে নীলার সাথে প্রথম যখন দেখা হয়েছিলো, ঠিক এই রকম অনুভূতি হয়েছিলো। কিছুক্ষণ স্থির, কিছুক্ষণ অস্থির। একটু পর পর আয়নাতে নিজের চেহারা দেখা। হঠাৎ করেই পোশাকের দিকে নজর দেওয়া! ঘন ঘন মোবাইল ফোনে একটি নির্দিষ্ট নম্বরের বাটন চাপা। প্রায় সারাক্ষণই নীলার সাথে কথা বলার আকুলতা! নীলাকে তো সুমিত ভালবেসেছিলো, কিন্তু শুচিস্মিতাকে? তাহলে কি সে এখন শুচিস্মিতাকে ভালোবেসে ফেলেছে? তা কি করে হয়? নীলা যে এখন সুমিতের ঘরনী! সুমিত যে এখনো নীলাকে ভালোবাসে। তবে কেনো শুচিস্মিতাকে দেখলে সুমিতের হার্ট বিট বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়! কেনো বার বার ওর সাথে সময় কাটাতে, ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে! কেনই বা শুচিস্মিতার কথা ভাবতে সুমিতের এতো ভালো লাগে!

কাহিনীর শুরুঃ

নতুন চাকরীতে নতুন জায়গায় এসে শুচিস্মিতার সাথে সুমিতের পরিচয়। প্রথম দিনেই শুচিস্মিতার প্রাণবন্ত কথা আর অদম্য উচ্ছ্বলতায় সুমিত খুব মজাই পেয়েছিলো!

চাকরী হচ্ছে এখন সোনার হরিন! এই সোনার হরিণই যেনো খুব সহজে সব সময় সুমিতের হাতে ধরা দিয়েছে। পড়াশোনা শেষ করে এই পর্যন্ত এক দিনও ওকে বেকার থাকতে হয় নি। একটার পর একটা চাকরী করেছে, ছেড়েছে, আবার নতুন একটা পেয়েছেও। এরই মধ্যে নীলাকে সাত পাঁকে বেঁধে ফেলেছে। ভালোবাসার বিয়ে। আজকালকার বাবা মায়েরা খুব আধুনিক। ছেলে মেয়েদের ভালোবাসার বিয়েতে কোনো অমত থাকেনা। কিন্তু সুমিতের গ্রামে বাস করা বাবা মা মন মানসিকতায় অনেকটাই সেকেলে। আধুনিক, উচ্চ শিক্ষিত, নম্র এবং সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও তাই নীলার সুযোগ হয় নি ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পদধূলি মাথায় নেবার!

নীলার কথাঃ

সুমিতের সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় এক যুগের। চঞ্চল, ছটফটে কিন্তু দুষ্টু যে ছেলেটাকে প্রথম দিন দেখেই আমি মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলাম, তাকে যে আমি আজীবনের জন্য পাবো সেটা চিন্তাই করিনি! তবু যেনো সব কীভাবে হয়ে গেলো! একটা ছোট্ট সংসার হলো আমাদের, টোনাটুনির সংসার। আমি আর সুমিত, সুমিত আর আমি।

স্বপ্নের মতো কেটে গেলো একটি বছর। সুমিতের অফিস থেকে বিকেলে আসার পরে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া- সবকিছুই দ্রুত চলে যেতে লাগলো। নতুন সংসারটিকে সাজিয়ে নিতে আমাদেরও যেনো কিছুটা সময় দিতে চাইলেন বিধাতা। এরই মাঝে একদিন আমাতে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব টের পেলাম আমি। অদ্ভুত এক শিহরণে শিহরিত হলাম। প্রবল উচ্ছ্বাসে সুমিতকে খবরটা দিতে গিয়েই জানলাম সুমিতকে গ্রামে যেতে হবে ওর বাবার মুখাগ্নি করতে।

সুমিতকে আমি একা ছাড়তে চাইলাম না। সব কাজ শেষ করে যখন আমরা ফিরে এলাম, আমাতে আর প্রাণের অস্তিত্ব পেলাম না! সুমিত কি খুব কষ্ট পেয়েছিলো সেদিন? জানি না! শুধু এটুকু জানি, আমি খুব কেঁদেছিলাম, অঝোর ধারায়।

পার্শ্ব কাহিনীঃ

এর কিছুদিন পরেই আমেরিকার খুব বড় একটি ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সুযোগ পেলো নীলা। সুমিত রইলো দেশে, একাকী। সময় কেটে গেলো দ্রুত। দুই বছর পর বিমান বন্দরে যখন নীলাকে সুমিত দেখতে পেলো, সুমিতের মনে হলো অসম্ভব রকমের বেশি ভালোবাসে সে এই মেয়েটিকে। খুব অবাক হলো, দুইটি বছর নীলাকে ছাড়া সে কীভাবে কাটিয়েছে!

এবার মনে হয় সময় হলো টোনাটুনির সংসারে এক নতুন অতিথি আসার। কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় এবারো মুখ তুলে চাইলেন না! রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝে থেকে সুমিত যখন নীলাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো, সুমিতের কাছে তখন যেনো সমস্ত পৃথিবীটাই দুলে উঠছিলো।

সুমিত নীলাকে ঠিকই যমরাজের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এলো, এরপর এভাবেই বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেলো। টোনাটুনির সংসারে নতুন কেউ না এলেও, ভালোবাসার যেনো কমতি নেই!

রোচিষ্ণুর কথাঃ

আমি রোচিষ্ণু। আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন এই লোকটা আবার কোত্থেকে উদয় হলো! তাই প্রথমেই আপনাদের সমস্ত কৌতুহল মিটাচ্ছি। আর কিছুদিনের মধ্যেই শুচিস্মিতার সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে। শুচিস্মিতাকে এখনো ভুলে যাননি তো আপনারা? হ্যা, শুচিস্মিতা হচ্ছে সুমিতের কলিগ। শুচিস্মিতার কাছেই আমি সুমিতের অনেক গল্প শুনেছি। অল্প ক’দিনের ভিতরেই সুমিত শুচিস্মিতার খুব কাছে চলে এসেছে। আমার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী  এই ব্যাপারটিতে আমার চেয়েও বেশি চিন্তিত হয়ে পরেছে! আমি কিন্তু কখনই চিন্তিত হই নি। কারণ, সেই ছোটবেলা থেকেই আমি শুচিস্মিতাকে চিনি। ও আমাকে বলেছে, সে সুমিতকে খুব ভালো একজন বন্ধুর মতোই দেখে। এখনো সুমিতকে আমার কথা বলে নি, কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই আমার সাথে দেখা করিয়ে দিয়ে সুমিতকে চমকে দিবে!

আমি শুচিস্মিতাকে অনেক, অ-নে-ক ভালোবাসি, ঠিক তেমনি অনেক, অ-নে-ক বিশ্বাসও করি।

বিরতির পরঃ

“সুমিত, আগামীকাল সন্ধ্যায় নান্দোসে আসতে পারবে? তোমাকে একটি কথা বলবো, ধরো তোমার জন্য এক সারপ্রাইজ!” সুমিত যেনো এই দিনের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে সিদ্ধান্ত নিলো শুচিস্মিতাকে সে ‘না’ বলবে না!

ভালোবাসা ব্যাপারটাই এরকম। যারা বলে থাকে জীবনে একবারই মাত্র ভালোবাসা হয়, সুমিত সেই দলের নয়। যে কারণে গুইনেভারা রাজা আর্থারকে ভালোবাসলেও, ল্যান্সেলটের প্রেমে পড়তে কোনো সমস্যাই হয় না। আবার বিয়ে করলেও যে অন্যের সাথে ভালোবাসা আর হবে না, সুমিত সেটাও বিশ্বাস করে না। এমনকি এটাকে সে অনৈতিকও ভাবে না! কারণ, রাঁধা তাহলে বিবাহিতা হয়ে কীভাবে কৃষ্ণের সাথে প্রেম করে? লাইলী মজনু বা রোমিও জুলিয়েটের কাহিনী আর বর্তমান যুগে খাটে না। “ভালোবাসা এমন কোনো বিষয় নয়, শুধু একজনে সীমাবদ্ধ থাকবে,” নিজেকে বোঝালো সুমিত। সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেললো।

একটু কি খারাপ লাগলো সুমিতের? নীলার জন্য কেমন যেনো মনটা টন করে উঠলো না! “সেটা একসাথে অনেক দিন থাকার জন্য। নীলার প্রতি একটা মায়া পড়ে গেছে না! কিন্তু সেটা শুধুই মায়া, ভালোবাসা নয়”, আবারো নিজেকে নিজেই উত্তর দিলো সুমিত।

সবচেয়ে মোক্ষম উত্তরটা একটু পরেই নিজেকে শোনালো সুমিত, “আমি বাবা হতে চাই”।

কাহিনীর শেষের আগেঃ

অফিসে আজ শুচিস্মিতা আসে নি, ছুটি নিয়েছে। সুমিত ওকে না দেখতে পেয়েই ফোন দিয়েছিলো। শুচিস্মিতা জানিয়েছে, এক বিশেষ কাজে ব্যস্ত। বিকেলে দেখা করার কথাও মনে করিয়ে দিলো। সুমিত স্মিত হেসে বললো, “মনে আছে!”

অফিস থেকেই সুমিত সোজা ধানমণ্ডির নান্দোসে গিয়ে শুচিস্মিতার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষার প্রহর যেনো দীর্ঘ! সহজে শেষ হতে চায় না! বার বার ঘড়ির দিকে আর প্রবেশ পথের দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ করেই যখন শুচিস্মিতাকে দেখলো, কোথায় যেনো নীলার ছায়াটাও দেখতে পেলো সুমিত! শুচিস্মিতা একা আসেনি, সাথে একজন সুদর্শন যুবকও আছে!

“এই হচ্ছে রোচিষ্ণু, সামনের সপ্তাহেই আমাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে। আর এটাই হচ্ছে তোমার জন্য সারপ্রাইজ……” আরো কি কি যেনো বলছিলো শুচিস্মিতা, কিন্তু কোনো কথাই মনে হয় শুনতে পাচ্ছিলো না সুমিত!

নীলার শেষ কথাঃ

আজকে আমার খুব আনন্দের দিন! কয়েকদিন আগেই আমার একটু সন্দেহ হচ্ছিল। আজ সকালে সুমিত অফিসে চলে গেলে আমি কনফার্ম হবার জন্য হাসপাতালে গেলাম। যা ভেবেছিলাম! আলট্রাসাউন্ড রিপোর্টে বলছে আমি ‘মা’ হতে যাচ্ছি! নিজের কানকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এতো বছর পর!

এতদিন নিশ্চিত না হয়ে সুমিতকে জানাতে চাচ্ছিলাম না। ভাবলাম অফিস থেকে এলে চমকে দিবো ওকে। কিন্তু আজ এই আনন্দের দিনেই ও খুব দেরী করে বাসায় এলো। দরজা খুলে ওর দিকে তাকাতেই কেমন যেনো বিধ্বস্ত লাগলো ওকে। ওকে সুস্থির হবার সময় দিলাম।

“তোমার বাবুর নাম তুমি কি রাখবে?” রহস্য করে সুমিতকে বললাম। সুমিত মনে হয় আমার কথাটা বুঝতে পারলো না, ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি হাসিমুখে আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। পড়তে পড়তে দেখতে পেলাম, ও কাঁদছে। আনন্দের কান্না! হঠাৎ করেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, “আমি তোমায় ভালোবাসি”।

আর যেনো কি বলতে লাগলো! ওহ হ্যা, মনে পড়েছে! আর বার বার বলতে লাগলো ‘আমায় ক্ষমা করো’।

সুমিত আসলেই খুব বোকা! কোন দিনে কি কথা বলতে হবে, এখনো শিখলো না! অফিসে কাজের চাপ এতো! যাহোক, কাঁদুক ও, কাঁদুক। বাবা হওয়ার সম্ভাবনায় কাঁদুক। ওর কান্না দেখতে আমার খুব ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে আমিও কাঁদি, মা হওয়ার সম্ভাবনায় কাঁদি আর বলি, “সুমিত, আমি তোমায় খুব ভালোবাসি”।

 

ক্যাডাভার


দিপু চুপচাপ ডক্টরস রুমে বসে আছে। রাত একটা বাজে। একটু আগে এক রোগী মারা গিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার রোগী। বয়স্ক পুরুষ, পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে বয়স হবে। পরনে খাকি রঙের লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবী। দিপু পরীক্ষা করার সময় খেয়াল করেছে ডান হাতার বগলের দিকে একটা ছোট ছিদ্র আছে। সাদা পাঞ্জাবীর জায়গায় জায়গায় ছোপ ছোপ রক্ত। মাথার দিকে একটা অংশ দেবে গেছে। কপালের অনেকটা জায়গা খুবলে গেছে।

সন্ধ্যার দিকে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটি মাইক্রোবাস লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে। আশেপাশের লোকজন সচকিত হবার আগেই মাইক্রোবাসের চালক ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এমনিতেই মহাসড়কের পাশে ছোট্ট একটা বাজার। লোকটার সাথে কিছুই ছিলো না। দুর্ঘটনা হবার পর যারা এসেছিলো তারা কেউ লোকটিকে চিনতেও পারলো না। চেনার চেষ্টা করতে করতেই কিছু সময় চলে গেলো। তারপর কি মনে করা দু’তিনজন যুবক ছেলে একটা ভ্যানে করে লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে এলো। কিছুক্ষণ পরেই ছেলেগুলোর আর খোঁজ পাওয়া গেলো না।

ইমার্জেন্সী বিভাগের ডাক্তার পোড় খাওয়া, অভিজ্ঞ। এরকম অবস্থার সম্মুখীন অনেকবার সে হয়েছে। সহজেই বুঝতে পারলো এই লোকের আত্নীয়-স্বজনের খবর পাওয়া অনেক কষ্টকর হবে। প্রথমে সে ভর্তিই করাতে চায়নি, কিন্তু যেহেতু সে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সী ডাক্তার, মাথায় আঘাতের জন্য নিউরোসার্জারীর জুনিয়র ডাক্তার দিপুকে খবর দিলো।

দিপু যখন দেখতে এলো তখন লোকটির কোনো জ্ঞান নেই, আসলে দুর্ঘটনার পর থেকেই লোকটি অজ্ঞান। লোকটিকে দেখে দিপু নিউরো ওয়ার্ডে ভর্তি করাতে বললো। বিপত্তি ঘটলো ভর্তির জন্য অগ্রিম টাকা দিতে গিয়ে। টাকা দেবারতো কেউ নেই! হাসপাতালের নিয়ম, কিছু টাকা অগ্রিম না দিলে রোগী ভর্তি করানো যাবে না। ডক্টরস রুমে দিপু আর ইমার্জেন্সী ডাক্তার মুখোমুখি বসে আছে। নিঃশব্দ! হঠাৎ করে দেয়ালের ঘড়ির ঘন্টার শব্দে দুইজনেই যেনো চমকে উঠে। অভিজ্ঞ ইমার্জেন্সী ডাক্তার ‘উফ’ বলে উঠে, “বয়স হয়ে গেছে, তাই মনেই পড়েনি। আমাদেরতো হাসপাতালের নাইট ম্যানেজারকে ডাকা উচিত ছিলো!”

দিপু কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে ফোনের দিকে হাত বাড়ায়।

ইকবাল সাহেব। রিটায়ার্ড আর্মি মেজর। এই বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভালো মাইনেতেই এসেছে। দেখতে রাশভারী মনে হয়, অবশ্য আর্মির সব লোকদেরই দিপুর কাছে তা মনে হয়। কিন্তু দিপু জানে ইকবাল সাহেব রাশভারী লোক নয়, আমুদে একজন মানুষ। তাকে দিপুর ভালোই লাগে। সেই রিটায়ার্ড আর্মি মেজর ইকবাল সাহেব ইমার্জেন্সীতে আসতে আসতেই কিছু সময় ব্যয় করে ফেলেন, ইমার্জেন্সীতে এসে দুই ডাক্তারের কাছ হতে পুরো ঘটনা শুনতে আরো সময় ব্যয় করেন।

“আর বলবেন না, এইসব ঝামেলার জন্যইতো আমরা আছি। আপনারা ঠিক কাজ করেছেন ভর্তি করানোর আগে আমাকে খবর দিয়ে। দেখি কী করা যায়!” তিনি কি করা যায় দেখার জন্য একটু সরে গিয়ে কাকে যেনো ফোন দিলেন। কাছে এসে বললেন, “আপনারা পুলিশে ফোন দিয়েছেন? এটাতো পুলিশ কেস!” দিপু কিছুটা অসহায় কন্ঠে বলে উঠে, “আপনি পুলিশে খবর দেন, আমাদের বলেন আমরা রোগীকে ভর্তি করাবো কি না? রোগীর অবস্থা খুব ভালো না।” “ঠিকাছে,ঠিকাছে। ভর্তি করান, তবে ওয়ার্ডে নিবেন না, ইমার্জেন্সীতেই রাখেন। পুলিশ আসুক,” কথাটা বলেই ইকবাল সাহেব আবার ফোন হাতে তুলে নিলেন।

দিপু রোগীর কাছে চলে গেলো। এখনো নিশ্বাস নিচ্ছে, শুধু সেটুকুই। কেটে যাওয়া কপালের দিকে তাকিয়ে সিস্টারকে বললো সেলাই দেবার জিনিসপত্র নিয়ে আসতে। লোকটির মাথার কাছে বসে ওয়াশ দিয়ে সেলাই করতে শুরু করলো। লোকটিকে দেখে ওর বাবার কথা মনে পড়ে গেলো, একই রকম বয়স। এই লোকটার মতোই লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরে। গ্রামে থাকে, ছোট খাট ব্যবসা করে। দিপু যখন সরকারী মেডিকেল কলেজে চান্স পেলো, ওর বাবার আনন্দ যেনো শেষ হয় না। সবাইকে বলে বেড়ায়, “আমার ছেলে ডাক্তার! আমার ছেলে ডাক্তার!” দিপু খুব লজ্জা পায়, ও যে তখনো মেডিকেলে ভর্তিই হয়নি। তারপর কীভাবে যে ছয়টা বছর কেটে গেলো! ইন্টার্র্নি শেষ করেই এই বেসরকারী মেডিকেল কলেজটার নিউরোসার্জারীতে চাকরী পেয়েছে। গ্রামে গেলে ওর বাবা এবার সবাইকে বলে বেড়ায়, “আমার ছেলে খুব বড় ডাক্তার!” দিপু এবারও খুব লজ্জা পায়। হঠাৎ করে আনমনে হেসে উঠে। লোকটির দিকে তাকিয়ে পরম মমতায় কপাল সেলাই করতে থাকে।

থানা থেকে পুলিশের একজন এস আই এসেছে। ইকবাল সাহেবের সাথে যেনো কি কি কথা বললো। একবার লোকটির চেহারা দেখেই চলে গেলো। দিপু সেলাই করার রুম থেকেই শুনতে পেলো এস আই ইকবাল সাহেবকে বলছে, “চলুন ইকবাল সাহেব, একটু চা খেয়ে আসি।” আবার সব চুপচাপ, শুনশান নিরবতা। শুধু দিপু একমনে লোকটির কপাল সেলাই করে যাচ্ছে।

দিপুর একবার মনে হলো ওর প্রফেসরকে ফোন করে, দিপুর সাথে ওর প্রফেসরের খুব ভালো সম্পর্ক। দিপু খুব ভালো জানে বা কাজ ভালো করে, যে কারণেই হোক, ওর প্রফেসর ওকে খুব পছন্দ করে। “স্যার, আপনি কী একটু দেখে যাবেন?” ফোনের অপর প্রান্তে কিছুক্ষণ সাদা, তারপর ওর প্রফেসর বলে উঠেন, “দেখো, যদি সকাল পর্যন্ত বাঁচাতে পারো, তাহলে আমি তখন দেখে যাবো। এখন এক দাওয়াতে আছি, আর রোগীর লোককে নেগেটিভ কাউন্সেলিং করে রাখো।”
– স্যার, রোগীর লোকই তো পাওয়া যাচ্ছে না!
– ও! তাহলে আর কী করা! দেখো, কী করতে পারো!

দিপু আর কথা বলতে পারে না, আসলে ওর কথা বলতে আর ইচ্ছে করে না। অনেকদিন আগের কথা ওর মনে পড়ে গেলো। তখনো ও মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়নি। ওর মায়ের খুব বুকে ব্যথা শুরু হলো। দিপু আর দিপুর বাবা খুব তাড়াতাড়িই থানা সদরের হাসপাতালে নিয়ে গেলো, তখনো সন্ধ্যা নামেনি। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় একটা স্যালাইন ঝুলিয়ে দিলো। ডাক্তারকে পেলো না। জানা গেলো, চেম্বারে আছেন তিনি, এখন আসতে পারবেন না। দিপু ওয়ার্ড বয়ের প্রতি ভরসা না করে ওই সময়েই জেলা শহরের হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দেয়। কিন্তু দূরত্বটা অনেক বেশী! এতটা সময় অপেক্ষা করতে দিপুর মায়ের ভালো লাগেনি, তিনি কাউকে কিছু না বলেই একদম চুপ হয়ে গেলেন। দিপুর ডাক্তার হবার জেদের শুরু তখন থেকেই। দীর্ঘশ্বাস ফেললো দিপু। ওর এখন মনে হচ্ছে ডাক্তার না হলেই মনে হয় ভালো হতো!

দিপু লোকটির দিকে তাকালো। এখনো শুধু নিশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু বুকের উঠা নামাটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। ও হঠাৎ চিন্তায় পড়ে গেলো। মনে করতে পারছে না, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া লোকদের পোস্ট মর্টেম করা হয় কি না। দিপুর ফরেনসিক মেডিসিনের টুরের কথা মনে পড়ে গেলো। ওরা যখন ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র, সরকারী হাসপাতালের মর্গে গিয়েছিলো পোস্ট মর্টেম দেখতে। বড় ভাইয়ারা বলেছিলো সেইন্ট আর রুমাল নিয়ে যেতে। ও বুঝতে পারেনি কেনো, তাই নিয়েও যায় নি। মর্গে যখন ডোম পানিতে ডুবে যাওয়া এক ব্যক্তির পেট কাটলো, ফুস করে বের হয়ে আসা গন্ধে দিপুর গা গুলীয়ে বমি আসতে চাইলো। ডোমের মুখ দিয়েও যেনো কী বিভৎস গন্ধ আসছিলো। যখন লোকটার মাথা হাতুড়ি আর বাটাল দিয়ে ভাঙ্গলো, দিপু সহ্য করতে পারেনি, বমিই করে ফেলেছিলো। পরে কিন্তু দিপু এটা নিয়ে লজ্জা পায়নি, কারণ সেদিন দুইটা মেয়ে অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিলো। আনমনে হেসে উঠলো দিপু।

মেডিকেলে প্রথম বর্ষে ডেড বডি কাটতে হয়, তখন ডেড বডিকে বলে ক্যাডাভার। প্রথম যেদিন ডেড বডি কাটবে, ওদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়ে গিয়েছিলো কে কাটবে সেটা নিয়ে। ফরমালিনের তীব্র গন্ধ সহ্য করেও ডেড বডির গা ঘেঁষে দাঁড়াতো সবাই। একবার এক মজার ব্যাপার হয়েছিলো। দিনটা ছিলো ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ওদের সেদিন হৃৎপিণ্ড কাটার কথা। কিন্তু সেদিন কেউই কাটতে চাইলো না, কিন্তু দিপুর ব্যাপারটা না জানা থাকায়, সেই হৃৎপিণ্ড কাটলো। এরপর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত ক্লাসের মেয়েদের কাছ হতে দিপুকে ‘হার্টলেস’ কথাটা শুনতে হয়েছে, এভাবেই হাড়ে হাড়ে সে ১৪ই ফেব্রুয়ারির মর্মার্থ বুঝতে পেরেছে। আর সে ছেলেই কি না পোস্ট মর্টেম দেখতে গিয়ে বমি করে দিয়েছে! আবারো আনমনে হেসে উঠলো দিপু, হাসি মুখেই আবার লোকটির দিকে তাকালো।

লোকটি আর নিশ্বাস নিচ্ছে না!

দিপু এখন চুপচাপ ডক্টরস রুমে বসে আছে। রুমের বাইরে ইকবাল সাহেবের কথা শুনতে পাচ্ছে, পুলিশের এস আই-এর সাথে ফোনে কথা বলছে। সব কিছু শুনতে না পারলেও ‘বেওয়ারিশ’ শব্দটা ভালো শোনা যাচ্ছে। একটু পরে ইকবাল সাহেবকে দেখা গেলো হাসপাতালের ডিরেক্টরের সাথে ফোনে কথা বলতে। কাজ যেনো এই মুহূর্তে সব ইকবাল সাহেবের!

*******************
মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের আজ ওরিয়েন্টেশন। বড় বড় নামকরা প্রফেসরদের খুব গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য শেষে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে প্রিন্সিপ্যাল কলেজ পরিদর্শনে বের হয়েছেন। এনাটমি ডিসেকশন হলে গিয়ে তিনি সবাইকে বলছেন, “এটা তোমাদের এনাটমি ডিসেকশন রুম। এখানে তোমরা ডেড বডি কাটবে। ডেড বডিকে কখনোই তোমরা ডেড বডি বলবে না, বলবে ক্যাডাভার। তাদের দেহকে কখনোই অসম্মান করবে না। যা হোক, ওই যে লম্বা টেবিলে একটি ক্যাডাভার দেখছ, সেটা তোমরাই কাটবে, তোমাদের জন্যই এই ক্যাডাভার আনা হয়েছে।” কিছু উৎসাহী ছাত্র ক্যাডাভারের দিকে এগিয়ে গেলো। বয়স্ক ব্যাকটি, পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে বয়স হবে। তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, ক্যাডাভারটার কপালে খুব সুন্দর করে একটা সেলাই দেওয়া আছে!

অন্ধকার পথ, পিছনে বন্ধ দরজা

রাত দুইটা বাজে। বারান্দাতে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে দিব্য। দিব্য, দেশের একজন প্রথম সারির প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। অগুনতি ভক্ত তার, বেশীর ভাগই অবশ্য উঠতি বয়সের যুবক-যুবতীরা। দিব্যের লেখায় এদেরকে নিয়ে অনেক কথা থাকে, এদের মনের কথা স্থান পায়, এদের চাহিদা, দুঃখ, কষ্ট, হাসি, আনন্দ-বেদনা সব চলে আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, এই বয়সের পাঠকেরা যা পড়তে চায়, দিব্য সেটাই লিখতে পারছে। এটা অনেকেই পারে না, পারে না তাদের হৃৎস্পন্দন বুঝতে। দিব্য বুঝতে পারে, এটা ওর খুব বড় একটা গুণ। তাই দিব্য এত জনপ্রিয়।

আর কিছুদিন পরেই একুশের বইমেলা। দিব্যকে কমপক্ষে তিনটা উপন্যাস লিখতে হবে, প্রকাশকরা প্রায় প্রতিদিনই তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু দিব্য কিছুই লিখতে পারছে না। কাগজ, কলম নিয়ে টেবিলে বসছে, বসেই থাকছে, সাদা কাগজগুলো কালো আঁকিবুকিতে আর ভরে উঠছে না। একবার ওর মনে হলো রাইটার্স ব্লক হয়েছে, কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সে কবিতা লিখতে পারছে, তাও খুব সুন্দর প্রেমের কবিতা। অথচ দিব্য কবিতা আগে কখনো লেখেনি বা লিখতেও জানত না। একবার ভাবে এবার কবিতার বই লিখবে, পরক্ষনেই মনে হয় পাঠকরা ওর উপন্যাসই পড়তে চায়। মনটাকে সুস্থির করতে বারান্দাতে পায়চারি করতে গিয়ে আরো অস্থির হয়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর অভিজাত এলাকার এপার্টমেন্টের ছয় তলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দিব্যের অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। এই নিশুতিরাত ওকে যেনো কি মনে করিয়ে দিচ্ছে। মধ্যবয়স্ক দিব্যের মনে পড়ে যাচ্ছে মেহেরের সাথে সেই উচ্ছ্বল দিনগুলোর কথা।

ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিলো মেহের। শুধু সুন্দরী নয়, চৌকসও বটে। পড়াশোনা, খেলাধুলা, বিতর্ক সবকিছুতেই ছিলো মেহেরের পদচারণা। সে তুলনায় মফস্বল থেকে আসা দিব্যই ছিলো কিছুটা ম্রিয়মান। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত ওর ছোট গল্পগুলো পড়ে মেহেরের কাছে সেই দিব্যই হয়ে উঠলো স্বপ্নের রাজকুমার। তারপর মেঘনার জল অনেক দূর গড়িয়ে গেলো। তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর বিয়ে করে থিতু হতে না হতেই ফুটফুটে অপর্ণার বাবা হয়ে গেলো দিব্য, ততদিনে অবশ্য লেখক হিসেবেও যথেষ্ট নাম যশ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। হিমেল হাওয়ার ঝাপটায় দিব্যের ভাবনায় ছেদ পরলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুমে ঢুকে বিছানার দিকে তাকাতেই কেমন যেনো কুঁচকে গেলো দিব্য।

বিছানাতে কেঁচোর মতো জট পাকিয়ে মেয়েটা শুয়ে আছে। দীঘল কালো চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে চারপাশে, কিছু চুল দিয়ে ঢেকে আছে একপাশের গালের কিছু অংশ। গভীর ঘুমে মগ্ন সে। শরীরে একটি সুতাও না থাকাতে প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বুকের ছন্দময় উঠানামাটা দিব্যের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে। পাশের বেডসাইট টেবিলের উপর রাখা ল্যাম্পের আলোয় কেমন যেনো অপার্থিব লাগছে। কী যেনো নাম মেয়েটার, দিব্য মনে করতে পারছে না। হঠাৎ ওর মনে হলো মেয়েটার নামই জিজ্ঞেস করা হয় নি, সন্ধ্যা থেকে একসাথে আছে অথচ মেয়েটার নামই জানা হয়নি ওর! অদ্ভুত দৃষ্টিতে মেয়েটার মায়াময় মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার বারান্দাতে চলে আসলো দিব্য।

আকাশে মেঘের গুরু ডাক। হয়তো বৃষ্টি নামবে, নতুবা নয়। একটা সিগারেট ধরালো দিব্য, বেনসন এন্ড হেজেস ব্রান্ডের। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আনমনে হাসলো সে। মেহেরের দিব্যকে পছন্দ করার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা ছিলো সে অধূমপায়ী। কিন্তু বিয়ের পর রাত জেগে জেগে উপন্যাস লিখতে লিখতে, প্লট চিন্তা করতে করতে কখন যে হাতে সিগারেট উঠে এলো সেটা ও বুঝতেই পারেনি। এরপর আরো কত কি- হাতে চলে আসলো বোতলও। জনপ্রিয়তার সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে দিব্যের রুচিবোধও অনেক উপরে উঠে এলো! প্রথম দিকে মেহের মনক্ষু্ন্ন হলেও কিছু বলতো না। কিন্তু যখন মধ্যরাতে সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষ করে অর্ধ মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতো, মেহের উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। সেই উত্তাপে ছোট্ট অপর্ণা ঘুম থেকে জেগে উঠে অবাক বিস্ময়ে বাবা-মায়ের দিকে তাকাতো, কাঁদতেও যেনো ভুলে যেতো। অপর্ণার যখন আলাদা রুম হলো, তখন আর ঘুম থেকে উঠতো না, কারণ সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। শুধু ভাবতো, বাবা খুব জনপ্রিয় না হলেই মনে হয় ভালো হতো। সময় যেনো কীভাবে গড়িয়ে যায়। অপর্ণা যখন ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করলো, বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে ওর বাবার অসম্ভব জনপ্রিয়তা দেখে ওর মায়ের অসহায় মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠতো।

মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। সেই বৃষ্টির কিয়দংশ ছিটে ফোঁটা দিব্যের গায়েও লাগছে। বিছানাতে শুয়ে থাকা মেয়েটার কথা আবার মনে পড়লো। এতক্ষন খেয়াল করেনি, এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা বোধহয় অপর্ণার সমবয়সী। গত সন্ধ্যায় যখন ক্লাবে মেয়েটাকে দেখে, ওর কেমন যেনো নেশার মতো লেগেছিলো। মেয়েটিকে দেখে কোনো বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়ে মনে হয়নি তখন। দিব্যের সাথে যখন দিব্যের উপন্যাসগুলো নিয়ে গল্প করছিলো, দিব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলো। রাতে যখন দ্বিধান্বিত কন্ঠে বাসায় আসার আমন্ত্রন জানালো, কী সহজেই না রাজী হয়ে গেলো! হেসে উঠলো দিব্য, অনেকদিন পর বিছানাতে এত তৃপ্তি পেলো সে, মেহেরের কাছ হতে যা প্রায়শই পেতো না। এই যুগের মেয়েরা বোধহয় এরকমই। দিব্যের মতো একজন মধ্যবয়স্ককেও, যার মাথার চুলে কিছুটা পাকও ধরেছে, মুহূর্তের মধ্যে উন্মাতাল করে ফেলতে পারে।

এই ব্যাপারটা যেদিন থেকে সে বুঝতে পেরেছিলো, সেদিন থেকেই তার শুরু হয়েছিলো মেহেরের সাথে লুকোচুরি খেলা। কোনো কোনো রাত বাসায় আসতো না, আসলেও ভোর রাতের দিকে এসে চুপিসারে শুয়ে পড়তো। মেহেরের ততদিনে অনেক কিছুই গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু যেদিন দিব্যের মোবাইলে দিপ্তী নামের এক মেয়ের কামোদ্দীপক মেসেজ পড়লো, সেদিন নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না। না, সে দিব্যের সাথে কিছুই করে নি, কারণ এই পুরুষ শাসিত সমাজে সে প্রতিবাদ করে কিছুই করতে পারবে না, বরঞ্চ নির্যাতিত হয়ে খবরের কাগজের শিরোনাম হবে। তাই সে তার স্বপ্নের রাজকুমারের ঘর ছেড়ে এসে, বুক ভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে নিজের জীবনকে আপন গতিতে চলতে দিলো। তার মেয়েটা হয়েছে তার ন্যাওটা, তাই অপর্ণাও চলে আসলো তার সাথে। সেই থেকে দিব্য একা।

হঠাৎ মৃদু শব্দে পিছনে ফিরে দেখলো দরজার পর্দা ধরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ঘুম জড়ানো মায়াবী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘুমাবে না?’ মেয়েটিকে চমকে দিয়ে দিব্য ওর নাম জানতে চাইলো। কিছুটা অদ্ভুত কন্ঠে মেয়েটা বললো, ‘মেহের’! দিব্য তাকিয়ে থাকলো মেয়েটির দিকে, তারপর বললো, ‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সকাল হলে আর বৃষ্টি থেমে গেলে তুমি চলে যেয়ো’।

রাত চারটার ঢাকা শহরে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে এক বাসার সামনে এসে থামলো দিব্য। তিনবার কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দাঁড়ালো মেহের।

– কেমন আছো মেহের? কেমন আছে অপর্ণা?
– এত রাতে তুমি?
– বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, না ভিতরে বসতে বলবে?

মেহের হেসে ফেললো। হাসলে মেহেরকে খুবই সুন্দর লাগে এই মধ্যবয়সেও। সে হেসেই বললো, ‘তোমাকে ভিতরে আসতে বলার সাধ্য আমার নেই। মেয়ে বড় হয়েছে, আমি তোমাকে ভিতরে আসতে বললে আমি ওর কাছে খুব ছোট হয়ে যাবো। আর সবচেয়ে বড়ো কথা তোমাকে ভিতরে বসতে বলার ইচ্ছেও আমার নেই, সে তুমি যাই মনে করো। ভোর প্রায় হয়ে এলো, অপর্ণা এখনই ঘুম থেকে উঠবে, আমি চাই না, সে তোমাকে দেখুক’।

মেহেরের দিকে কিছুক্ষন স্থির তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে দিব্য বের হয়ে আসলো। গাড়ির দিকে না এগিয়ে এই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই ভোরের আলোতে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলো, কিন্তু দিব্যের মনে হলো সে অন্ধকার পথে হাঁটছে। একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে।

নন্দিতা, এই লেখা তোমার জন্য……

নন্দিতার সাথে আমার পরিচয়টা হয়েছিলো খুব সাধারণভাবে। আমি ঢাকা থেকে বাসে করে সিরাজগঞ্জে আসছিলাম, আমার পাশের সিটটাতেই বসেছিলো নন্দিতা। বয়স আঠারো-উনিশের মতো হবে (মেয়েদের বয়স বলার ক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়ই আমার ধারণা ভুল হয়ে থাকে), একটু লম্বাই হবে, ধরুন পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি, দেখতে শিল্পা শেঠীর মতো-হ্যাঁ, ঠিক এই নামটাই আমার মনে হলো। বাস ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে সে বাসে উঠলো, বিদায় দিতে সাথে এসেছিলো গুরুগম্ভীর স্বভাবের একজন বয়স্ক ব্যক্তি, কথা শুনে মনে হলো মামা সম্পর্কীয়।

দূরপাল্লার যাত্রাগুলোতে বাসে পাশের সিটে কোনো সুন্দরী থাকলে সময়টা খুব খারাপ কাটে না, কথা বলা হোক বা না হোক, আড়চোখে তাকাতে তাকাতে আর মেয়েটিকে নিয়ে নানা চিন্তা করতে করতে কখন যেনো গন্তব্যস্থল এসে যায়। সেবার অবশ্য এরকম কিছু হয়নি, হয়নি নন্দিতার জন্য। বাস ছেড়েছে দশ মিনিটও হয়নি, নন্দিতা আমার দিকে ফিরে সুন্দর একটি হাসি দিয়ে রিনরিনে কন্ঠে বলল, ‘আমি নন্দিতা, থাকি সিরাজগঞ্জে, এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকাতে মামার কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আপনি?’ আমি নন্দিতার সাবলীল কথা বলার দক্ষতায় প্রচন্ড বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ডাক্তার, এটা শোনার পর বাচ্চা মানুষের মতো বায়না ধরলো বিভিন্ন অপারেশনের গল্প শুনবে। কথায় কথায় এক সময় জানিয়ে দিলো ছোটবেলায় তার খুব ডাক্তার হবার ইচ্ছে ছিলো, বন্ধুরা যখন ডাক্তার-রোগী খেলতো, সবসময় সে ডাক্তারই হতো। কমার্সের ছাত্রী হওয়াতে সেই স্বপ্নটা একটা বড় ধাক্কা খেলো। কোথা থেকে যে সময় পেরিয়ে গেলো, আমরা বুঝতেই পারলাম না। যমুনা সেতু পার হয়ে বাস সয়দাবাদে আসলে আমি নেমে গেলাম। নন্দিতা জানালার পাশে বসে হাত নাড়িয়ে হাসিমুখে বিদায় নিলো। আর আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলাম।

সেই ঘটনার প্রায় চার মাস পর। বিভিন্ন রকম ব্যস্ততায় নন্দিতাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। একদিন হঠাৎ করে লাল সালোয়ার কামিজ পরে মোহনীয় রুপে হাসপাতালে এসে আমার সামনে হাজির। প্রথমে চিনতেই পারি নি, ‘আমি নন্দিতা’ বলার পর একটু লজ্জাই পেলাম। মিষ্টি হেসে আমার হাতে একটি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ভাইয়া, অবশ্যই আসবেন কিন্তু।’ কার্ডটা খুলে দেখি নন্দিতার বিয়ের কার্ড, ওর দিকে তাকাতেই দেখি লজ্জায় ওর ফর্সা গালটা রক্তিম হয়ে উঠেছে। জানালো বিয়ের পর ঢাকাতেই থাকবে, ওর স্বামী ঢাকাতে একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে ভালো বেতনের চাকরি করে। এই অল্প বয়সে ওকে বিয়ে দেবার রহস্যটা এবার বুঝতে পারলাম।

বিয়েতে আমি যেতে পারি নি, ঐ সময়ে ব্যক্তিগত ব্যস্ততার জন্য ঢাকাতে থাকায়। এরপর অনেকদিন আর দেখা হলো না নন্দিতার সাথে, অবশ্য দেখা হবার কথাও না।

প্রায় এক বছর পর। একদিন ছুটিতে ঢাকায় গেলে আমার এক বন্ধু বিকেল বেলায় আমাকে নিয়ে তার এক বন্ধুর বাসায় এলো একটি জরূরী কাজের কথা বলে, আমাকে অনেকটা জোর করেই নিয়ে আসলো। নন্দিতা! এবার আর চিনতে কষ্ট হয় নি। বুঝতে পারলাম আমাকে ষড়যন্ত্র করেই আনা হয়েছে চমকে দেবার জন্য, আমিও চমকিত হলাম। আমার বন্ধুবরের বন্ধুর স্ত্রী নন্দিতা। কোনো একদিন কথা প্রসঙ্গে আমার বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পেরেছে আমার কথা, অতএব আমাকে না জানতে দিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে আসা। নন্দিতার স্বামী ভদ্রলোকটিকে আমার ভালোই লাগলো। চমৎকার করে কথা বলেন, প্রাণখোলা ধরনের। হাসি, ঠাট্টায়, গল্পে রাতের খাবারের সময় হলে নন্দিতা না খাইয়ে ছাড়তে চাইলো না। আমার বন্ধুর আবার ভোজন রসিক হিসেবে খুব নাম ডাক, তাই অনুরোধটা এড়ানো গেলো না।

নন্দিতা যখন খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলো, তখন ওর স্বামী বললো নন্দিতার ব্রেইন টিউমার হয়েছে, আগামী সপ্তাহে ঢাকার একটা বড় হাসপাতালে অপারেশন হবে। আমি চমকে গেলাম। কিছুক্ষন কোনো কথাই বলতে পারলাম না। রাতে খাবারের টেবিলে নন্দিতা অনেক মজার মজার কথা বললো, খাবারটাও দারুন হলো। কিন্তু কোনো কথাই আমি আর মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারলাম না, খাবারটাও গলা দিয়ে ঢুকতে পারলো না। বাকীটা সময় ফ্যাল ফ্যাল করেই তাকিয়ে রইলাম।

দুই সপ্তাহ আগে নন্দিতার অপারেশন হলো, আমি গত সপ্তাহে ঢাকায় গেলে ওকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। ওকে কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছে। সেই আগের মতোই চঞ্চল, ছটফটেই আছে। আমি যাবার পর বলল, ‘ভাইয়া, আমার হিস্টোপ্যাথলজি রিপোর্টে জিবিএম, গ্রেড-ফোর এসেছে। আমার স্বামী আমাকে জানতেই দেই নি। আমি নিজে ফাইলে রিপোর্ট দেখলাম। এরপর মোবাইলে ইন্টারনেটে দেখলাম খুব বেশী হলে দেড়-থেকে দুই বছর বাঁচবো। দেখুন তো ভাইয়া, রাব্বি (নন্দিতার স্বামী) সারাক্ষন মনমরা হয়ে থাকে। আমি ওকে বললাম, এই দুইটা বছর আনন্দে বেড়াই, আর ও বলছে কি রেডিও না কেমোর জন্য সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবে। আমার চিন্তায় সারাক্ষন অস্থির হয়ে থাকে। আপনি একটু ওকে বোঝান তো।’ আমি আবারও ফ্যাল ফ্যাল হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এক সময় নন্দিতা বললো, ‘ভাইয়া, বিয়ে করেছেন পাঁচ বছর হলো, এখনো কোনো বাবু নেন নাই! তাড়াতাড়ি নিয়ে নেন, আমি দেখে যাই। আর মেয়ে হলে নাম রাখবেন নন্দিতা, কি রাজী আছেন তো?’ ওর পাশে বেশীক্ষন থাকাটা খুব কষ্টকর হয়ে উঠলো। আমি ব্যস্ততার কথা বলে চলে আসলাম। কেবিনের দরজায় এসে পিছনে তাকিয়ে দেখি, রাব্বি গভীর মমতায় নন্দিতার বিছানার পাশে বসে ওর হাত ধরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসলাম। এমন সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। আমি আশে পাশে কোথাও ঠাঁই খুঁজলাম না। বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে থাকলাম। এক সময় লক্ষ্য করলাম বৃষ্টির পানির সাথে আমার চোখের পানিও মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

অপুর ভাবনা

অপু লঞ্চের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বুড়িগঙ্গার কালো কুচকুচে কালো পানি দেখছে। অনেক বিখ্যাত লোকের পুরান ঢাকার স্মৃতিচারণমূলক লেখায় সে পড়েছিলো বুড়িগঙ্গা পাড়ের নির্মল হাওয়ার কথা, বুড়িগঙ্গা্র স্বচ্ছ পানির কথা, কিন্তু অপুর মনে পড়ে না সে কখনো কালো কুচকুচে পানি ছাড়া অন্য কিছু দেখেছে কি না। একটু দূরে ডকে দাঁড়িয়ে এক ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে ঝাল মুড়ি খাচ্ছে। টার্মিনালের উপর সারি সারি ফলের অস্থায়ী দোকান, আম, আপেল, আঙ্গুর আরো কত কি। অসংখ্য মানুষের এখানে ওখানে ছোটাছুটি, যে যার নির্দিষ্ট লঞ্চ খুঁজে নিয়ে লঞ্চের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। কেউ কেউ নৌকায় করে ওই পাড় থেকে এসে নৌকা থেকে সরাসরি লঞ্চে উঠছে। অসংখ্যবার দেখা এইসব পুরানো দৃশ্য কেনো যেনো আজ অপুকে বিষন্ন করে তুলছে।

একটানা কিছুক্ষন হর্ন বাজিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে লঞ্চ ছেড়ে দিলো। আস্তে আস্তে সদর ঘাট দূরে সরে গেলো। সন্ধ্যার হিমেল বাতাস অপুকে স্পর্শ করা মাত্রই সে কেবিনে ঢুকে গিয়ে ব্যাগ থেকে শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীন’ বইটি বের করে পড়া শুরু করলো। অনেকবার পড়া এই বইটি অপুর খুব প্রিয় একটি উপন্যাস। কিন্তু এর আগে যতবারই সে পড়েছে, তারচেয়ে আজ যেনো আরো খুব বেশী আবেগী হয়ে উঠছে। ধ্রুব আর ওর বাবার মানসিক দ্বন্দ্ব পড়তে পড়তে কখন যে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে, অপু সেটা খেয়ালই করেনি। লঞ্চের খাবারের ছেলেটা এসে দরজায় নক করে যখন জিজ্ঞেস করলো কি খাবে, কোনো সময় না নিয়ে বলে ফেললো ডাল চর্চরি আর রুই মাছ। একটু পরে আনমনেই হেসে উঠলো, অপু আসলে কখনো মাছ খায়না। কাঁটা বাছতে খুব কষ্ট হয় বলে মাছ খাওয়া তার কখনো হয়ে উঠেনি, অথচ নদী পথের যাত্রায় কেনো যেনো সবসময় মাছই ভালো লাগে। ছেলেটি যখন খাবারের সাথে একটু জলপাইয়ের আচার নিয়ে আসলো মনে মনে অপু খুব খুশিই হয়ে উঠলো।

খাওয়া শেষ করে অপু আবার বাইরে এসে দাঁড়ালো। লঞ্চ যেমন নদীর জলরাশিকে দুই দিকে কেটে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি রাতের দূরন্ত বাতাসও অপুর চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। আজ বোধহয় পূর্নিমা নয়, তারপরও অর্ধাচন্দ্রাকৃ্তি চাঁদকে খুব একটা খারাপ লাগছে না। এই চাঁদের আলোতেই মাঝ রাতের অন্ধকারকে ভেদ করে কিছুটা দূরে ছোট ছোট মাছ ধরা নৌকা দেখা যাচ্ছে ঢেউয়ের তালে উঠছে আর নামছে। নৌকার ভিতর থেকে আসা হারিকেনের ম্লান আলো দেখতে দেখতে অপুর কাছে হঠাৎ করে ইঞ্জিনের মৃদু গুমগুম শব্দটাকেও খুব মায়াময় মনে হচ্ছে। বরঞ্চ মাঝে মাঝে লঞ্চের একেবারে সামনের সার্চলাইটের আলো-ই ওকে বিরক্ত করে তুলছে।

কি মনে করে অপু লঞ্চের ছাঁদের উপরে উঠলো। কাউকে দেখতে পেলো না। ছাদটির ঠিক মাঝখানে সে বসে পরলো। লঞ্চের মৃদু দোলায়, বাতাসের সুরেলা শব্দে, চাঁদের সূর্য থেকে ধার করা আলোয় অপু হঠাৎ করেই ডুকরে কেঁদে উঠলো, ওর বুকের ভিতরটা এক অব্যক্ত যন্ত্রনায় মোচড় দিলো।

অপুর অনেক কথাই মনে পড়ছে। কিছুদিন আগেও যখন এভাবে ওর বাবার সাথে গ্রামের বাড়িতে যেতো, অপুকে কখনই এই মাঝরাতে ওর বাবা ছাঁদে উঠতে দিতেন না। কেবিন থেকে বের হলেই বলতেন ঠান্ডা লাগবে। লঞ্চের সবাই ওর বাবাকে চিনতো বঙ্গোপসাগরের পাশে এক দ্বীপের সবচেয়ে বড় সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে, খুব খাতির করতো লঞ্চের লোকেরা। সেই খাতিরের একটু আধটু ছিটে ফোঁটা অপুও তখন পেতো। অপুর বাবা ওকে বলতেন, ‘দেখ্ দেখ্, এদেরকে চিনে রাখ্, আমি যখন থাকবো না, তখন এরাই কাজে লাগবে’। না, এরা আজ কোনো কাজেই আসেনি, কেবিন খালি থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত টাকা দিয়ে অপুর কেবিন পেতে হয়েছে। অপুর বুক টা আবার হু হু করে কেঁদে উঠলো।

অপু যখন ওর বাবার সাথে গ্রামে যেতো, লঞ্চ যখন ঘাটে ভিড়তো, দেখতো গ্রামের অনেক লোক এসেছে ওর বাবাকে নিয়ে যেতে, উপজেলার ইউএনও পাঠিয়ে দিতেন তাঁর গাড়ি, ওসি আসতেন ফোর্স নিয়ে। এত এত লোকজনের ভিড়ে, অনেক পিছনে পরে থাকা, ওদের বাড়ির ম্যানেজার নিজাম কাকাকে দেখাই যেতো না।

অপুর গ্রামের বাড়িতে সবচেয়ে ভালো লাগে ওদের বাড়ির পাশের পাটগাছের বাগানটাকে। ছোটবেলায় ও যখন গ্রামে আসতো, দিনের বেশিরভাগ সময় পাট বাগানে থাকতো, আর বাগানের ফাঁকে ফাঁকে থাকা বেত গাছের ছোট্ট সবুজ দানার মতো ফল লবণ-মরিচ দিয়ে খুব মজা করে খেতো। বাড়ির পিছন দিকের ধান ক্ষেতগুলো যখন নদীর জোয়ারের পানিতে ডুবে যেতো, তখন ওর সমবয়সী ছেলেদের সাথে যেতো বরশি দিয়ে মাছ ধরতে, অপুর বরশিতে বেশির ভাগ সময়ই ধরা পরতো কাঁকড়া, ছোট ছোট কাঁকড়া।

একবার এক মজার কান্ড ঘটলো। অপুর বয়স তখন আট কি নয়, সে সাঁতার জানতো না। কিন্তু গ্রামের তিন বছরের পিচ্চিও দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাপ দিয়ে সাঁতার কাটা শুরু করতো। অপুর মনে হলো সেও যদি দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাপ দেয়, তাহলে সাঁতরাতে পারবে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। দূর থেকে দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাপ এবং হাবুডুবু খেতে খেতে পুকুরের নিচে তলিয়ে যাওয়া। সে যাত্রায় সেই ছোট ছোট পিচ্চিদের জন্যই ওর প্রাণ রক্ষা হয়েছিলো।

অপুর ভালো লাগতো ধান কাটার মৌসুম আর শীতকালে গ্রামে আসতে। বর্গাচাষীরা ধান কেটে এনে বাড়ির সামনে মাচা বানাতো। সব ধান কাটা হয়ে গেলে গরু দিয়ে ধান মাড়াই হতো। অপুও গরুগুলোর পিছনে পিছনে ধান মাড়াই করতো, লুটোপুটি খেতো, আর সারারত চুলকানিতে ঘুমাতে পারতো না। শীতকালে সবচেয়ে ভালো লাগতো সকাল বেলায় খেঁজুর গাছের কাঁচা রস খেতে। এই সময়টাতে সে দেখতো বাড়ির উঠানে বিশাল বিশাল মাটির চুলা তৈরী করে টিনের বিশাল বিশাল পাতিলে কাচা রসকে জ্বাল দিয়ে খেজুরের রসের গুড় তৈরি করা হতো। সেই গুড় দিয়ে এরপরে শীতের পিঠা খাওয়া হতো।

এইসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই অপুর খেয়াল হলো পুব আকাশে সূর্য উঠি উঠি করছে। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই লঞ্চ ওদের গ্রামের ঘাটে ভিড়বে। অপু ছাদ থেকে নেমে কেবিনে ঢুকে গেলো। কেবিনে ঢুকেই বিছানাতে ‘দূরবীন’ দেখে ধ্রুব-এর শেষ কথা মনে পড়ে গেলো, ধ্রুব-এর মতোই অপু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, ‘বাবা’।

অপু লঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে ওদের গ্রামের ঘাট দেখা যাচ্ছে। সেই ঘাটে শুধুমাত্র ওদের বাড়ির ম্যানেজার নিজাম কাকা ছাড়া আর কেউ অপুর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।

একটি সাধারণ গল্প

(১)

আমি আনিসুর রহমান। এটা আমার ছদ্ম নাম, কেনো আমি আসল নাম দিচ্ছি না, আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আমি ঢাকায় থাকি, একটি বহুজাতিক কোম্পানীতে কর্মরত আছি। বয়স ধরুন পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের ভিতর। আমি বিবাহিত, আমার স্ত্রী মারুফা। সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে- মারুফাকে দেখলেই তা মনে হয়, আমার কাছে আমার দেখা সবচেয়ে রুপবতী এবং গুনবতী মহিলা। আমার দুইটি পরী আছে, একজনের বয়স পাঁচ বছর, নাম অর্পা। আরেকজনের বয়স তিন বছর, নাম পূর্বা। আমাদের এই চারজনের ছোট্ট সংসার খুব ভালোভাবেই চলছিল।

হঠাৎ একদিন একটি খবর এই সুখের সংসারের সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। অনেকদিন ধরেই মারুফা একটি সমস্যার কথা বলছিল। অফিস থেকে সময় বের করতে পারি নি, আলসেমীও কম দায়ী নয়, বেশকিছু দিন পর ডাক্তার দেখানোর পর যা জানতে পারলাম, খুব ভালো লাগলো না। ডাক্তার বলছেন, মারুফার নাকি ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে। আগে অপারেশন করতে হবে, তারপর অবস্থা বুঝে কেমো বা রেডিওথেরাপী।

আমিও হাইপারটেনশনের রোগী। মারুফার এই অবস্থায় একটু ঘাবড়েই গেলাম, কিন্তু মনোবল হারাইনি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাহসের দিন ছিল মারুফাকে জানানো। ওকে বলার পর দেখলাম, কিছুক্ষন চুপ ছিলো, তারপর হাসিমুখে বললো, কবে অপারেশনের টেবিলের নিচে শুতে হবে। বুক থেকে সঙ্গো্পনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

মেয়ে দু’টিকে নানা বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। এরপর এলো সেই দিন। ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতালে অপারেশন করা হলো। ডাক্তার বললেন, অপারেশন সফল হয়েছে। চিকিৎসার পরবর্তী ধাপ নির্ভর করবে বায়োপসি রিপোর্টের উপর। পোস্ট-অপারেটিভ রুমে মারুফাকে দেখতে গেলাম। হাসিমুখে আমাকে পাশে বসে ওর হাতটা ধরে থাকতে বললো। আমি তাই করলাম।

(২)

আমি মারুফা রহমান। এটা আমার ছদ্ম নাম, কেনো আমি আসল নাম দিচ্ছি না, আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আমি একজন গৃহিনী, সংসার সামলানোই আমার কাজ। আমার পরিচিতজনেরা বলেন আমি নাকি এই কাজটা খুব সুন্দরভাবে করতে পারি। আমার স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসেন, তারচেয়েও বেশী ভালোবাসেন আমাদের দুই পরী অর্পা আর পূর্বাকে।

গত কিছুদিন ধরে আমার ব্রেস্টে ব্যথা করছে। আমার স্বামীকে বলার পর একদিন আমরা ডাক্তার দেখাতে গেলাম। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে দিলেন। রিপোর্ট গুলো দেখে আমার স্বামীকে আলাদাভাবে কি যে বললেন, তারপর থেকেই তাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখলাম। কিছু একটা আমাকে বলতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না।

অবশেষে একদিন আমার কাছে এসে বললো একটা কথা বলবে। আমি ঠিক করেছি যত কঠিন কথাই হোক তা হাসিমুখে শুনবো। সে আমাকে বললো, আমার ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে, অপারেশন করতে হবে। এরপর বায়োপসি রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কেমো বা রেডিওথেরাপী দিবে। আমি অভয় দিলাম।

মেয়ে দু’টিকে নানা বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। এরপর এলো সেই দিন। ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতালে অপারেশন করা হলো। ডাক্তার বললেন, অপারেশন সফল হয়েছে। কিছুক্ষন পর দেখলাম আমার স্বামী আমাকে দেখতে আসলো। কেনো জানি না হঠাৎ করে আমার মনে হলো আমি বোধহয় আর ভালো হবো না। আমার ছোট্ট দুইটা মেয়ের কথা মনে পড়লো। আমার স্বামীকে বললাম আমার হাত ধরে বসে থাকতে, সে তাই করলো। হঠাৎ আমার হাতের উপর তার চোখের পানি পরলো, শক্ত করে আমরা হাত ধরে থাকলাম।

(৩)

আজ এক সপ্তাহ হলো মারুফার রেডিও থেরাপী চলছে, সিরাজগঞ্জের কেওয়াইএএমসিএইচে। ওর বায়োপসি রিপোর্ট ভালো আসেনি, ক্যান্সারটা শেষ পর্যায়ে। আমরা অনেক দেরী করে ফেলেছি। মারুফার মাথার চুল সব পরে যাচ্ছে, চেহারা কেমন যেন শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব কষ্ট লাগছে, খুব।

আজ মারুফা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। ডাক্তাররা বলছেন, তারা চেষ্টা করছেন, কিন্তু ভরসা পাচ্ছেন না। আমার শরীরটাও খুব ভালো যাচ্ছে না। প্রেশারের ওষুধ ঠিকমতো খাওয়া হচ্ছে না, খুব দুর্বল লাগছে। একটু বিশ্রাম নেওয়া উচিৎ।

(৪)

গত দুই দিন ধরে আমার কিছুটা ভালো লাগছে। ডাক্তাররা বলেছিলেন, আমি নাকি প্রায় তিনদিন অজ্ঞান ছিলাম, যমে মানুষে টানাটানি। আমার স্বামী না কি খুব কষ্ট করেছে, এই ক’দিন। সারাক্ষন আমার পাশে ছিলো। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, নাওয়া কিছুই হয়নি তার। ওর নিজেরও প্রেশারের সমস্যা। আমার জ্ঞান ফেরার পর ওর সাথে আমার দেখা হয়নি। আমার দেবর বললো, সে না কি অফিসের জরুরী কাজে ঢাকায় গেছে, আসতে কিছুদিন সময় লাগবে। মেয়েদেরকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।

(৫)

আমি নিয়াজ, একজন ডাক্তার, নিউরোসার্জন। পাঁচদিন আগে রাত দুইটার সময় ইমার্জেন্সীভাবে হাসপাতালে আসতে হয়েছিলো। একজন ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে ইমার্জেন্সীতে এসেছে। সিটি ব্রেন করে দেখা গেলো বিশাল বড় একটা হেমোরেজ, ব্রেন স্ট্রোক করেছে, অবস্থা খুব ভালো না। রোগীর সাথের লোকদের কাছ হতে শুনলাম, রোগীর স্ত্রী এই হাসপাতালেই ক্যান্সার বিভাগে ভর্তি আছে, রেডিও থেরাপী পাচ্ছে। গত দুই দিন ধরে সে অজ্ঞান হয়ে আছে, এই চিন্তায় তার স্বামী খুব অস্থির ছিলেন। প্রেশারের রোগী ছিলেন, ঠিকমতো ওষুধও খান নি।

আজ সকালে রোগীটি মারা গেছেন। আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম, সম্ভব হয় নি। শুনতে পারলাম, তার স্ত্রীর না কি জ্ঞান ফিরেছে, স্বামী যে একই হাসপাতালে ভর্তি তা জানতেন না। তাকে তার স্বামীর মৃত্যুর খবরও দেওয়া হয়নি। তাদের ছোট ছোট দুইটি মেয়েও আছে। খুব খারাপ লাগছে আমার, খু-উ-ব।

(৬)

পাদটীকাঃ আনিসুর রহমান মারা যাবার এক সপ্তাহ পর তার স্ত্রী মারুফা রহমানও মারা যান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মারুফা জানতেন তার স্বামী বেঁচে আছেন।

এটি একটি সাধারণ গল্প নয়, একটি সাধারণ সত্য কাহিনী।