দেবতাদের পুনরাগমণ

“ত্রয়োদশ যুগের শেষে, যখন ইটজা ক্ষমতার শীর্ষে থাকবে, সে সাথে টানকাহ নামের শহরটিও, তখন ইশ্বরের সংকেতও উচ্চতায় উঠে আসবে এবং ‘ক্রস’, যার দ্বারা বিশ্ব আলোকিত হয়েছিল, তা প্রকাশিত হবে। ভবিষ্যতের সময়ে পুরুষদের ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য দেখা দিবে, যখন এই সংকেত আসবে… তোমরা (সে সময়ে) পূর্ব থেকে আসা দাড়িওয়ালা অতিথিদের গ্রহণ করো, যারা ইশ্বরের সংকেত নিয়ে আসবেন, যারা আমাদের কাছে দয়া ও করুণা নিয়ে আসবেন। আমাদের জীবনের সময় আসছে…”

মায়াদের, বিশেষত ইউকাটান মায়াদের ধর্মীয় গ্রন্থ ‘চিলাম বালাম’এ এভাবেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এই ভবিষ্যদ্বাণী। ফলে মায়ারা পূর্ব দিক থেকে আসা দাড়িওয়ালা স্প্যানিশ অতিথিদের গ্রহণ করেছিলেন!

কোয়াটজালকোয়াটল টলটেক জাতিদের সৃষ্টিকর্তা দেবতা, তিনি ছিলেন সকাল ও সন্ধ্যার তারা। অনেক অনেক পরে যখন অ্যাজটেকরা মেক্সিকোতে তাদের প্রভাব বিস্তার করেন, তখন তারাও কোয়াটজালকোয়াটলকে তাদের দেবতা হিসাবে গ্রহণ করেন। পুরাণে ছিল, কোয়াটজালকোয়াটল সাপে পরিপূর্ণ ভেলাতে করে পূর্ব দিকে সাগরে হারিয়ে গিয়েছেন। তিনি আবার ফিরে আসবেন- টলটেকদের কিংবদন্তী রাজা টোপিল্টজিনের রূপে। তাই খ্রিষ্টাব্দ ১৫১৯ সালে পূর্ব দিক থেকে যখন স্প্যানিশ হারনান কর্টেস এসেছিলেন, অ্যাজটেক রাজা দ্বিতীয় মক্টেজুমা তাঁকে কোয়াটজালকোয়াটল হিসাবে বরণ করে নিয়েছিলেন। ফলে, অ্যাজটেক সাম্রাজ্য স্প্যানিশদের পদানত হয়েছিল!   

ইনকা রাজা হুয়ানা কাপাক যখন মৃত্যু শয্যায় ছিলেন, তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী হুয়াসকারকে প্রাচীন ইনকা পুরাণের কথা স্মরণ করিয়ে বলেছিলেন, “ত্রয়োদশতম ইনকা রাজার সময়ে, যখন তোমরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়বে, তখন পূর্ব দিক থেকে আমাদের সূর্য দেবতা আসবেন। আমি তোমাকে আদেশ দিচ্ছি, তুমি তাদেরকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে গ্রহণ করবে, তাদের বাধ্যগত থাকবে। তারা অবশ্যই তোমার চেয়ে অনেক উন্নত প্রকৃতির হবে, তারা ইনকাদের শাসন করবে!”  

হুয়াসকার এবং তাঁর ভাই আতাহুয়ালপা যখন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছিলেন, স্প্যানিশরা এসেছিলেন পূর্ব দিক থেকে! ইনকাদের সূর্য দেবতা ফিরে এসেছেন! ফলে ফ্রান্সিসকো পিজারোর পক্ষে খুব একটা অসম্ভব হয়ে উঠেনি বিশাল ইনকা সাম্রাজ্যকে পরাভূত করতে!

মায়া, অ্যাজটেক এবং ইনকা- মেসো-আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার তিনটি মহান সভ্যতা। এই তিনটি সভ্যতারই সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটেছিল স্প্যানিশদের কাছে। বলা হয়ে থাকে, এত সহজে স্প্যানিশরা এদেরকে জয় করতে পেরেছিলেন- তিন সভ্যতার এই তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য- যেখানে প্রতিটিতেই বলা হয়েছে- দেবতা পুনরাগমণ ঘটবে! তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন- কর্টেস কিংবা পিজারো- সেই দেবতা, যার পুনরাগমণ ঘটেছে তাঁদেরকে শান্তি এনে দেবার জন্য।

এই তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যাসত্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, এমনকি মাঝামাঝি সময়েও ঐতিহাসিকরা এই পুরাণগুলোর সত্যতা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু এখন ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন, মূল কোনো গ্রন্থে এগুলোর অস্তিত্ব ছিল না। স্প্যানিশরাই এই পুরাণগুলোকে নিজেদের সুবিধামত পরিবর্তন করেছেন।

এই পুরাণ বা ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আসলেই ছিল, না কি এগুলো স্প্যানিশদের হাতে পরিবর্তিত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা এই গ্রন্থের নির্দিষ্ট অংশে বিস্তারিত আলোচনা করব; তবে এটুকু স্বীকার করা কঠিন নয় যে, শুধু এসব ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য নয়, আরো অনেক কারণেই এই তিনটি সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের প্রবল আগ্রহ আছে। আমাদের আগ্রহ আছে মায়া পিরামিড নিয়ে, মায়া হায়ারোগ্লিফ নিয়ে। আমরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম খ্রিষ্টাব্দ ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর- এই বুঝি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল! আমাদের আগ্রহ আছে মায়া ক্যালেন্ডার নিয়েও। আমরা প্রবল ইচ্ছা আছে জানার অ্যাজটেকদের কী পরিমাণ সোনা-রূপা ছিল? সত্যিই কি তারা সোনাকে হেলাফেলার মত এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতেন? আমাদের ভীষণ তৃষ্ণা আছে জানার – এল ডোরাডো কোথায় আছে?

এই জানার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকেই এক মলাটের ভিতরে তিনটি বিশাল সভ্যতাকেই নিয়ে আসার এক দুর্দান্ত দু:সাহসিক প্রচেষ্টা হচ্ছে এই গ্রন্থটি।

মায়া, অ্যাজটেক এবং ইনকা সভ্যতার বেশ কিছু সাধারণ উপাদান আছে, যেমন চাষ করা, সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা, অনেক দেবতাদের উপাসনা করা। প্রকৃতপক্ষে এই তিনটি সভ্যতা যেসব ভূ-খন্ডে অবস্থিত ছিল, সেসব ভূ-খন্ডের বৈচিত্রের মতই সভ্যতাগুলোও বৈচিত্রময় ছিল। মায়ারা বিকাশ করেছিল গণিত ব্যবস্থাকে, অ্যাজটেকরা গড়ে তুলেছিল বড় এবং জনবসতিপূর্ণ শহর টেনোচটিটলান এবং ইনকারা আন্দিজ পর্বতমালার উঁচুতে অবস্থিত তাদের সাম্রাজ্যকে একত্রিত করার জন্য রাস্তা এবং সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োগ করেছিল প্রকৌশলী বিদ্যার। এসব কিছু নিয়েই

“মিথলজির আদি অন্ত- ওলমেক থেকে ইনকা”

ভালোবাসার ওয়াটার লিলি

অনেক অনেক দিন আগের কথা। এখনকার মতো তখনো আমাজন বিশাল নদী ছিলো। নদী তীরবর্তী এলাকা ছিলো বন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সেই জঙ্গলের পাশেই বাস করতো রেড ইন্ডিয়ানদের এক গোত্র। সেই গোত্রে ছিলো এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। আশে পাশের গোত্রে তার মতো সুন্দরী কেউ ছিলো না।

এক পূর্নিমার রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই মেয়েটি খুব মুগ্ধ হয়ে গেলো। চাঁদের অপরূপ রপে যেনো সে মাতোয়ারা। বাবাকে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, চাঁদে কে থাকে? রেড ইন্ডিয়ানদের এক প্রাচীন বিশ্বাসমতে, তার বাবা জানালো, চাঁদ হচ্ছে  এক অসম্ভব সুন্দর এবং শক্তিশালী যুদ্ধ-দেবতার বাসস্থান।

যতই সময় যেতে লাগলো মেয়েটির মনে এই বিশ্বাস ততোই গাঢ় হতে লাগলো। এক সময় মেয়েটি চাঁদের এই রহস্যময়ী যুদ্ধ দেবতার প্রেমে পড়ে গেলো। তার সারাটি সময় যেনো কাটে চাঁদের যুদ্ধ দেবতার কথা চিন্তা করে। এদিকে একদিন তার বিয়ের বয়স হলো। আশে পাশের গোত্র থেকে অনেক সুদর্শন যুবক, এমনকি অনেক গোত্রপতিও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন। মেয়েটির বাবা, মা, আত্মীয় স্বজন সবারই পাত্র খুব পছন্দ হয়, কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই কারো সাথে বিয়েতে রাজী হয় না। বাবা- মা অনেক করে বোঝাতেন, কিন্তু কোনো চেষ্টায়ই সাফল্য পেলো না। মেয়ের একটি মাত্র কথা, সে বিয়ে করবে চাঁদের যুদ্ধ দেবতাকেই।

মেয়েটির বাবা বললেন, আগের দিনের রেড ইন্ডিয়ানরা খুব বোকা রকমের ছিলো। নিজেরা অনেক কিছু কল্পনা করে নিতো। চাঁদের যুদ্ধ দেবতাও এই রকম এক কল্পনার দেবতা। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্বই নেই। মেয়েটি সেই কথা কানেই তুললো না। প্রতি পূর্নিমার রাতে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো, কখন চাঁদ পুরোপুরি গোল হবে, কখন চাঁদের যুদ্ধ দেবতাকে দেখা যাবে!

চাঁদ যখন পুরোপুরি গোল হতো, মেয়েটি চাঁদের আলোকে জড়িয়ে ধরতো। এমনকি চাঁদের রেখাকে জড়িয়ে ধরার জন্য সে আলোর পিছনে পিছনে জঙ্গলেও ঢুকে যেতো। সে অনুভব করতো আলোর রেখাকে জড়িয়ে ধরার মাধ্যমে যেনো যুদ্ধ দেবতাকেই ভালোবেসে জড়িয়ে ধরছে। এমনি এক পূর্নিমার রাতে চাঁদের আলো রেখাকে জড়িয়ে ধরার জন্য মেয়েটি ছুটতে লাগলো। ছুটতে ছুটতে কখন যে আমাজনের পাড়ে চলে এলো, খেয়ালই করেনি। এর আগে মেয়েটি কখনই আমাজনের কাছে আসে নি।

কৌতূহল নিয়ে আমাজনের দিকে তাকালো। সেই সময়ে আমাজনের পানি ছিলো খুবই স্বচ্ছ, আজকের যুগের মতো ঘোলাটে নয়। সেই স্বচ্ছ পানিতে মেয়েটি তাকিয়ে দেখলো পূর্নিমার চাঁদকে! মেয়েটি যেনো অবশেষে তাঁর চাঁদের যুদ্ধ দেবতাকে পেলো! যেনো চাঁদের যুদ্ধ দেবতা মেয়েটির ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে এই আমাজনের বুকে নেমে এলো। সেই চাঁদকে আর চাঁদের যুদ্ধ দেবতাকে ভালোবাসার বন্ধনে আটকে রাখার জন্য, জড়িয়ে ধরার জন্য কোনো কিছুই চিন্তা না করে মেয়েটি লাফ দিলো আমাজনের বুকে!

ভালোবাসার প্রতীক সেই হতভাগ্য রেড ইন্ডিয়ান মেয়েটি সাঁতার জানতো না। ভালোবাসতে গিয়ে, ভালোবাসার মানুষকে পেতে গিয়ে মেয়েটি চিরতরে হারিয়ে গেলো আমাজনের নীল পানির গভীরে।

চাঁদে কিন্তু এক যুদ্ধ দেবতা ঠিকই ছিলো। আগেকার দিনের রেড  ইন্ডিয়ানদের প্রাচীন বিশ্বাস সত্যই ছিলো। চাঁদ থেকে সেই অসম্ভব এবং শক্তিশালী যুদ্ধ দেবতা সব কিছুই দেখলেন। অনুভব করলেন মেয়েটির ভালোবাসার প্রবল শক্তিকে। চাঁদের সেই যুদ্ধ দেবতা চাইলেন মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনতে এই পৃথিবীতে। কিন্তু দেবতাদের রাজা চাঁদের দেবতাকে মৃত্যুকে জীবিত করার ক্ষমতা দিলেন না। আশাহত চাঁদ দেবতা তার সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমতা প্রয়োগ করে মেয়েটিকে আমাজনের বুকে এক বিশাল ফুলে পরিণত করলেন, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলজ ফুল। এভাবেই সেই দিন থেকে আমাজনে ওয়াটার লিলির জন্ম, যে ফুলটাকে আমরা এখনকার যুগে বলি ওয়াটার লিলি, ভিটোরিয়া রেজিয়া প্রজাতি, যে ফুল একমাত্র প্রতি পূর্নিমার রাতেই পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত হয়। যেনো আমাদেরকে জানিয়ে দেয় সেই রেড ইন্ডিয়ান মেয়েটি আর তার ভালোবাসার চাঁদের যুদ্ধ দেবতার কথা।

Vitória Régia, Water lily

(ব্রাজিলের লোকগাঁথা)

ফারাও এবং বুদ্ধিমান চোর

অনেক অনেক দিন আগের কাহিনী। মিশরে তখন ফারাওদের যুগ। সবে মাত্র র‍্যাম্পসিনিটাস মিশরের ফারাও হলেন। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডটাসসহ অনেকেই এঁকে তৃতীয় রেমেসিস নামে অভিহিত করেছেন। বলা হয়ে থাকে মিশরের সমস্ত ফারাওদের মধ্যে র‍্যাম্পসিনিটাসই ছিলেন সবচেয়ে ধনী ফারাও। তার সম্পত্তির মধ্যে ছিলো জুয়েলারী, অলংকার আর স্বর্ণমুদ্রাসহ আরো অনেক কিছু। প্রতিদিনই তিনি নতুন নতুন জুয়েলারি তার ভাণ্ডারে যোগ করতেন।

Rhampsinitus

ফারাও র‍্যাম্পসিনিটাসের সম্পদরাশি

ছোটবেলায় ক্লাসের বাংলা বইতে ‘সুখী মানুষ’ নামে একটি গল্প পড়েছিলাম। যার কিছুই নেই, এমনকি গায়ে পরিধানের জন্য নেই কোনো জামা- সেই সবচেয়ে সুখী। আর যার যতো প্রাচুর্য্য, সেই ততো অসুখী। আমাদের কাহিনীর ফারাও র‍্যাম্পসিনিটাসও ছিলেন খুব অসুখী। তিনি সর্বদাই তার এই বিশাল সম্পদ নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন এই বুঝি কোনো চোর এসে চুরি করে সব নিয়ে গেলো! অবশেষ তিনি এক সিদ্ধান্ত নিলেন।

এক ইঞ্জিনিয়ার (মানে তখনকার কারিগর)- কে দিয়ে র‍্যাম্পসিনিটাস একটি পাথরের ঘর বানালেন, যেখানে কোনো দরজা নেই, জানালা নেই। ঘরটির এক দিক ছিলো প্রাসাদের সাথে। সেই দিকে ইঞ্জিনিয়ার একটি পাথর এমনভাবে রাখলেন যে শুধুমাত্র র‍্যাম্পসিনিটাসই একটি স্প্রিং-এর সাহায্যে পাথরটিকে সরাতে পারবেন। যাক! র‍্যাম্পসিনিটাস এবার তার বিশাল সম্পদরাশি নিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন, আর চুরির ভয় রইলো না!

Rhampsinitus

র‍্যাম্পসিনিটাসের সম্পদ ঘর

বিপদটা এলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। জানি না সত্য, না মিথ্যা- সম্রাট শাহজাহান না কি তাজমহল তৈরীর পর এর প্রধান রাজমিস্ত্রী ঈসা মিয়াকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন, যেনো একই রকম তাজমহল আর কেউ তৈরী করতে না পারে! র‍্যাম্পসিনিটাসের বোধহয় উচিৎ ছিলো ইঞ্জিনিয়ারের কোনো ব্যবস্থা করা!
বেশ ক’বছর পর, যখন ইঞ্জিনিয়ার মৃত্যুশয্যায়, তার দুই ছেলেকে ডেকে বললেন, “আমি এখন মৃত্যুশয্যায়। তোমাদের জন্য কিছুই করে যেতে পারলাম না। তবে আজ তোমাদেরকে একটা গোপন কথা বলবো। ফারাও-এর সম্পদ ঘরটির পিছন দিকে আমি একটি পাথর এমনভাবে রেখেছি, যা সামনের দিকের পাথরটির মতোই স্প্রিং- এর সাহায্যে খোলা যাবে, যা কেউ জানে না। এমনকি ফারাও পর্যন্ত না! তোমাদের যখন যা প্রয়োজন হবে, ঠিক ততটুকুই নিবে- বেশি না।”

ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে রাতের আঁধারে সম্পদ ঘরটির কাছে গিয়ে তাদের বাবার কথামতো ঠিক জায়গায় সেই পাথরটির দেখা পেলো। এরপর ঘরটির ভিতরে ঢুকে পকেটে এবং ব্যাগে যতটুকু ভরলো, ততটুকু নিয়ে চলে এলো। পরদিন সকালবেলা ফারাও র‍্যাম্পসিনিটাস সম্পদ ঘরে প্রবেশ করেই বুঝতে পারলেন কিছু জিনিস কম মনে হচ্ছে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না, কীভাবে চোর এই ঘরে ঢুকবে! এভাবে বেশকিছু দিন পর, যখন তার খুব প্রিয় একটি নেকলেস পাওয়া গেলো না, তখন তিনি চোর ধরার জন্য ঘরের ভিতরে এক ফাঁদ পাতলেন।

সেদিন রাতে দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট ভাই আগে ঘরটিতে ঢুকতে গিয়ে ফাঁদে পা আটকে গেলো। বড় ভাই অনেক চেষ্টা করেও ছোট ভাইকে মুক্ত করতে পারলো না। ছোট ভাই তখন বললো, “আমাকে এখানে পেলে ফারাও আমাকে চিনে ফেলবে, তখন তোমাকেও খুঁজে ফেলবে। আমাদের দুজনকেই তখন মেরে ফেলবে। পরিবারের উপর বিপদ নেমে আসবে। তারচেয়ে বরং, আমার মাথা কেটে নিয়ে যাও, এতে আমাদের পরিবারের কোনো বিপদ হবে না!”

অন্য কোন উপায় না থাকায়, বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মাথা কেটে নিয়ে গেলো। পরদিন সকালে ফারাও সম্পদ ঘরে গিয়ে মুন্ডুবিহীন শরীর দেখে চিনতে পারলো না। ফারাও র‍্যাম্পসিনিটাস হতাশ হলেও বুদ্ধি হারান নি। তিনি বুঝতে পারলেন, আরেকজন এই চুরির সাথে জড়িত আছে, যে মাথাটা কেটে নিয়ে গিয়েছে।

তিনি এই মুণ্ডুবিহীন শরীরটাকে প্রাসাদের বাইরে ঝুলিয়ে রাখলেন, গোপনে কিছু সৈন্য পাহারা দিতে লাগলো। কেউ যদি এই শরীরটা নিতে আসে, তখনই তাঁকে পাকড়াও করা হবে, কারণ সে হবে চোরের দ্বিতীয় সঙ্গী।

ভাইয়ের মাথা কেটে আনার পর থেকে বড় ভাই খুব মনোকষ্টে ছিলো। চিন্তা করছিলো কীভাবে ছোট ভাইয়ের দেহ সমাধিস্থ করবে। সে এক বুদ্ধি বের করলো। এক গাধার পিঠে করে কিছু মদের পিপে নিয়ে প্রাসাদের সামনে দিয়ে যেতে লাগলো। সৈন্যদের কাছে এসে সে একটি পিপা ফুটো করে দিলো, সেখান থেকে মদ ঝরতে লাগলো। এরপর শুরু করলো কান্না। সৈন্যরা সে কান্না শুনে বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। “পিপা ফুটা হয়ে মদ ঝরছে। মালিক আমাকে আস্ত রাখবে না,” বলে আবার কান্না শুরু করলো বড় ভাই। সৈন্যরা তাকে সান্তনা দিলো, বললো ব্যাপারটা তারা দেখবে। বড় ভাইও খুশি হয়ে পিপার মদ সৈন্যদের খাওয়াতে লাগলো, একটু বেশি পরিমাণে।

সব সৈন্যরা মদ খেয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো। রাতের বেলা বড় ভাই এসে ছোট ভাইয়ের শরীরটা নিয়ে গিয়ে সমাধিস্থ করলো। ফারাও আবারো বুদ্ধির খেলায় চোরের কাছে হেরে গেলো!

এবারো ফারাও র‍্যাম্পসিনিটাস হতাশ হলেন না। আরেকটি বুদ্ধি বের করলেন, তবে এবার সাহায্য করতে হলো ফারাও-এর সুন্দরী মেয়েকেও। ফারাও রাজ্যে ঘোষনা দিলেন, রাজ্যের সবাইকে তাদের জীবনের সবচেয়ে বুদ্ধিমূলক কাজের কথা রাজকন্যাকে বলতে হবে এবং রাজকন্যার যারটা ভালো লাগবে, তাকে সে যা চাইবে, তাই দিবে। ব্যাপারটা হলো যে ব্যক্তি সম্পদ ঘরে মাথা কাটা এবং শরীর নিয়ে যাবার কাহিনী বলবে বুঝতে হবে সেই চোর, এবং তখন তাকে ধরা হবে। সেই সময়ে মনে হয় সবাই সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ছিলো, যে কারণে মনে হয় কেউ মিথ্যা কথা বলতে পারে সে চিন্তা ফারাও-এর মাথায় আসেনি!

বড় ভাই এবার তার জীবনের সবচেয়ে বড় বুদ্ধির খেলা খেললো। এক কবরস্থানে গিয়ে এক লাশ থেকে একটি হাত কেটে নিলো। সেই হাতকে চাদরের মধ্যে দিয়ে এমনভাবে ধরে রাখলো যেনো মনে হলো আসল হাত। বড় ভাই যখন রাজকন্যাকে সম্পদ ঘরে ছোট ভাইয়ের মাথা কাটা এবং প্রাসাদের সামনে থেকে শরীর নিয়ে যাবার কাহিনী বলতে লাগলো, রাজকন্যা হঠাৎ করে বড় ভাইয়ের হাত ধরে ফেললো, চিৎকার করে সৈন্যদের ডাকতে লাগলো।

কোথায় বড় ভাই! কোথায় হাত! সেখানে তো এক মৃতদেহের হাত! বড় ভাই ততক্ষণে হাওয়া!

এবার ফারাও র‍্যাম্পসিনিটাস হতাশ হলেন। ঠিক করলেন যে চোরের বুদ্ধির কাছে তিনি বার বার হেরে যাচ্ছেন, তার সাথে আর বিরোধ নয়। ঘোষণা দিলেন, চোরকে নিজের পরিচয় প্রকাশ করার। তখন বড় ভাই এসে ফারাও-এর কাছে নিজের পরিচয় দিলো। ফারাও র্যা ম্পসিনিটাস খুশি হয়ে বড় ভাইকে রাজসভায় শুধু স্থানই দিলেন না, রাজকন্যার সাথে বিয়েও দিলেন।

এরপর থেকে বড় ভাই আর রাজকন্যা সুখে শান্তিতেই বসবাস করতে লাগলো।

(সব মিথোলজী যেভাবে শেষ হয়, এটা সেভাবে শেষ হলো না, বরঞ্চ মনে হলো রূপকথা। তাই এটাকে গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডটাস মিশরীয় মিথ বললেও আমার এটাকে মিশরীয় রূপকথাই বলতে ইচ্ছে করছে।)

Herodotus

হেরোডটাস- যিনি এই কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গেছেন

মারিয়া মোরেভনাঃ যার জন্য প্রিন্স ইভানের যতো অভিযান

অনেক অনেক বছর আগে, এখন যাকে আমরা রাশিয়া বলে জানি, সেখানে এক রাজা এবং রানী ছিলেন। তখন রাশিয়ার রাজাকে বলা হতো জার। সেই জারের ছিলো এক ছেলে এবং তিন সুন্দরী মেয়ে। ছেলের নাম ছিলো প্রিন্স ইভান আর মেয়েদের নাম ছিলো মারিয়া, ওলগা ও অ্যানা। একদিন জারের দুয়ারে মৃত্যুরাজ এসে দাঁড়ালে জার প্রিন্স ইভানকে কাছে ডাকলেন। বললেন, “আমার যাবার সময় হয়ে গেছে। আমার পর তুমিই হবে এই বিশাল দেশের জার। রাজ্য শাসন নিয়ে তোমাকে কিছু বলবো না, তুমি তা ভালোই জানো। তোমাকে শুধু বলে যাচ্ছি, তুমি তোমার বোনদের প্রতি খেয়াল রেখো। যখনই কেউ এসে তোমার বোনদের বিয়ে করতে চাইবে, তুমি অমত কোরো না।”

জার মারা যাবার পর ইভান তার তিন বোনকে নিয়ে একদিন প্রাসাদের বাগানে ঘুরছিলেন। হঠাৎ করে পুরো আকাশ জুড়ে মেঘ করলো, মুহূর্তেই আশপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেলো। ভীষন বজ্রপাত হওয়া শুরু করলো। ইভান তার বোনদের দ্রুত প্রাসাদে চলে যেতে বললো। সবাই প্রাসাদে প্রবেশ করা মাত্রই দূর আকাশ থেকে এক বিশাল ফালকন পাখি মুখ থুবড়ে প্রাসাদে এসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে সেই ফালকনটি একজন সুদর্শন যুবকে পরিণত হলো। ফালকনটি প্রিন্স ইভানকে বলল, “এর আগে আমি তোমার এখানে মেহমান হিসেবে এসেছিলাম। এবার এসেছি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আমি তোমার বোন মারিয়াকে বিয়ে করতে চাই।” ইভানের তার বাবার শেষ কথা মনে পড়ে গেলো, মারিয়াও সুন্দর চেহারা দেখে ফালকনকে ভালোবেসে ফেললো। ফালকনটি মারিয়াকে বিয়ে করে নিজের দেশে নিয়ে গেলো।

চিত্র ১: ফালকনটি মারিয়াকে বিয়ে করতে চাইলো

এক বছর পর। ইভান তার দুই বোন নিয়ে প্রাসাদের বাগানে সান্ধ্য ভ্রমন করছিলো। ঠিক সেই সময়ে সেই এক বছর আগেকার মতো সমস্ত আকাশ মেঘে ঢেকে গেলো, মুহূর্তেই আশপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেলো। ভীষন বজ্রপাত হওয়া শুরু করলো। সবাই প্রাসাদে প্রবেশ করা মাত্রই দূর আকাশ থেকে এক বিশাল ঈগল পাখি মুখ থুবড়ে প্রাসাদে এসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে সেই ঈগলটি আগের ঘটনার মতোই একজন সুদর্শন যুবকে পরিণত হলো। সে এবার ওলগাকে বিয়ে করতে চাইলো। ইভান এবং ওলগা রাজী হওয়াতে ঈগলটি ওলগাকে বিয়ে করে নিজের দেশে নিয়ে গেলো।

আরো এক বছর পর। একদিন সন্ধ্যা বেলা ইভান তার ছোট বোন অ্যানাকে নিয়ে প্রাসাদের বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছিলো। ঠিক সেই সময়ে আগের দুই বছরের মতোই হঠাৎ করে সমস্ত আকাশ মেঘে ঢেকে গেলো, মুহূর্তেই আশপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেলো। ভীষন বজ্রপাত হওয়া শুরু করলো। ওরা দুইজনই প্রাসাদে প্রবেশ করা মাত্রই দূর আকাশ থেকে এবার এক রাভেন (সামুদ্রিক পাখি) মুখ থুবড়ে প্রাসাদে এসে পড়া মাত্রই একজন সুদর্শন যুবকে পরিণত হলো এবং অ্যানাকে বিয়ে করে নিজের দেশে নিয়ে গেলো।

এবার ইভান খুব একা হয়ে গেলো। বিশাল প্রাসাদে একা থাকতে থাকতে তার খুব অসহ্য লাগছিলো। সবসময় তার বোনদের কথা মনে পড়তো। এক সময় আর থাকতে না পেরে তার সভাসদদের ডেকে বললো, “আমি অনেক দিনের জন্য বাইরে ভ্রমনে যাচ্ছি। কবে আসবো জানি না। বোনদেরও দেখার খুব ইচ্ছে। এই সময়টা তোমরাই দেশটাকে শাসন করো। আমি আগামীকাল ভোরেই বের হবো।”

ইভান একা একা রাজ্য থেকে বের হলো, ঘুরতে ঘুরতে এক বিশাল মাঠে চলে এলো। সেই মাঠে ছড়ানো ছিটানো অনেক সৈন্যের মৃতদেহ দেখে সে চমকে উঠলো। চিৎকার করে বললো, “কেউ কি বেঁচে আছে?” লাশের ভিতর থেকে এক অর্ধমৃত সৈনিক ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠলো, “পাশের দেশের সুন্দরী রানী মারিয়া মোরেভনা যুদ্ধে আমাদের পরাজিত করেছে। সে এখন মাঠের অন্য প্রান্তে সাদা তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছে।”

চিত্র ২ : সেই মাঠে ছড়ানো ছিটানো অনেক সৈন্যের মৃতদেহ দেখে সে চমকে উঠলো

ইভান মাঠের অন্য প্রান্তের সাদা তাঁবুর কাছে গেলো। সুন্দরী রানী মারিয়া মোরেভনাকে দেখে ইভান কোনো কথাই বলতে পারলো না। হেসে ফেলে রানী জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কে গো? কি চাও এখানে?” ইভান যেন মোহমুগ্ধের মতো বলে যাচ্ছে, “আমি ইভান। রাশিয়ার জার। এখানে আমি যুদ্ধের জন্য আসেনি, এসেছি শান্তির বার্তা নিয়ে।” রানী মারিয়া ইভানকে বললো, “ঠিক আছে, তুমি তাহলে বিশ্রাম করো।”

চিত্র ৩ : সুন্দরী রানী মারিয়া মোরেভনাকে দেখে ইভান কোনো কথাই বলতে পারলো না

ইভান তিনদিন তিনরাত বিশ্রাম নিলো। সে রানী মারিয়ার প্রেমে পড়ে গেলো, রানী মারিয়াও এই তিনদিনে ইভানকে ভালোবেসে ফেললো। অবশেষে তারা বিয়ে করে মারিয়ার দেশে ফিরে গেলো।
বেশ কিছুদিন পর রানী মারিয়া আরেকটি যুদ্ধ করার জন্য অন্য এক দেশে চলে গেলো। যাওয়ার আগে ইভানকে বলে গেলো, “আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। এই সময়টুকু দেশের শাসনভার তোমার উপর দিয়ে গেলাম। তুমি যে কোনো কিছু করতে পারবে, শুধুমাত্র এই প্রাসাদের সবচেয়ে উঁচু গম্বুজের বন্ধ করা রুমে কখনো ঢুকো না।” মানুষের মন সবসময়ই নিষেধকে অমান্য করতে চায়। মারিয়া চলে যাবার কিছুদিন পরেই ইভান সেই রুমে ঢুকলো।

রুমে ঢুকেই এক দৈত্যকে দেখতে পেলো। সেই দৈত্য আবার সাতটা লোহার শিকল দিয়ে আটকানো, অসম্ভব দুর্বল হয়ে আছে। দৈত্যটি ইভানকে দেখে কাতর কন্ঠে বললো, “আমি দশ বছর ধরে না খেয়ে আছি। আমাকে একটু পানি খাওয়াবে?” দয়াপরবশ হয়ে ইভান দৈত্যটিকে তিন গামলা পানি খাওয়ালো। শেষ গামলা পানি খেয়েই দৈত্যটি লোহার শিকলগুলোকে টান দিয়ে ছিড়ে ফেললো, শরীরে যেনো সে প্রবল শক্তি ফিরে পেলো। আর পাবেই না কেনো? সেতো যে সে দৈত্য নয়, সে হচ্ছে কসচেই দ্য ডেথলেস (Koschei the Deathless- এক ভয়ংকর দৈত্য, যে শুধু সুন্দরী অল্প বয়ষ্ক মেয়েদেরই ক্ষতি করে)! লোহার শিকল থেকে মুক্ত হয়েই সে ঝড়ো হাওয়ার মতো গম্বুজের জানালা দিয়ে উড়ে গেলো, যাবার সময় ইভানকে বলে গেলো, “তুমি আর কখনোই তোমার প্রিয়তমা মারিয়াকে দেখতে পাবে না!” কসচেই পথেই মারিয়াকে পেয়ে গেলো, মারিয়া তখন যুদ্ধ শেষে প্রাসাদে ফেরত আসছে। কসচেই সেখান থেকেই মারিয়াকে বন্দী করে নিজের প্রাসাদে নিয়ে গেলো।

চিত্র ৪ : ভয়ংকর দৈত্য কসচেই দ্য ডেথলেস

ইভান তার বোকামির জন্য অনুশোচনায় পুড়তে লাগলো, একই সাথে মারিয়ার শোকও ভুলতে পারলো না। অনেকদিন যখন পেরিয়ে গেলো, তখনো যখন ইভান মারিয়াকে ভুলতে পারলো না, ইভান সিদ্ধান্ত নিলো সে মারিয়াকে উদ্ধার করতে যাবে।

তিনদিন ঘোড়ায় চড়ার পর বিশাল এক প্রাসাদের কাছে এসে থামলো ইভান। ইভান যখন পাশের ওক গাছের নীচে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসল, তখনই এক বিশাল ফালকন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে ইভানের বোন মারিয়ার স্বামী এবং প্রাসাদটি ফালকনের। ফালকন ইভানকে নিয়ে প্রাসাদে গেলো। দুই ভাই বোনের বহুদিন পরে আবার দেখা হলো, দুইজনই দুইজনকে জড়িয়ে ধরলো। তিনদিন তিনরাত ইভান এখানে থাকলো। যাবার সময় ফালকন আর বোন মারিয়ার অনুরোধে তার সিলভার চামচটি দিয়ে গেলো।

আবার তিনদিন ঘোড়ায় চড়ার পর প্রথমটার চেয়ে আরো বিশাল এক প্রাসাদের কাছে এসে থামলো ইভান। ইভান যখন পাশের ওক গাছের নীচে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসল, তখনই এক বিশাল ঈগল তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে ইভানের বোন ওলগার স্বামী এবং প্রাসাদটি ঈগলের। ঈগল ইভানকে নিয়ে প্রাসাদে গেলো। দুই ভাই বোনের বহুদিন পরে আবার দেখা হলো, দুইজনই দুইজনকে জড়িয়ে ধরলো। তিনদিন তিনরাত ইভান এখানে থাকলো। যাবার সময় ঈগল আর বোন ওলগার অনুরোধে তার সিলভার কাঁটা চামচটি দিয়ে গেলো।

আবার তিনদিন ঘোড়ায় চড়ার পর প্রথম দুইটার চেয়ে আরো বিশাল এক প্রাসাদের কাছে এসে থামলো ইভান। ইভান যখন পাশের ওক গাছের নীচে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসল, তখনই এক বিশাল রাভেন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে ইভানের বোন অ্যানার স্বামী এবং প্রাসাদটি রাভেনের। রাভেন ইভানকে নিয়ে প্রাসাদে গেলো। দুই ভাই বোনের বহুদিন পরে আবার দেখা হলো, দুইজনই দুইজনকে জড়িয়ে ধরলো। তিনদিন তিনরাত ইভান এখানে থাকলো। যাবার সময় রাভেন আর বোন অ্যানার অনুরোধে তার সিলভার তামাক বাক্সটি দিয়ে গেলো।

আরো তিনদিন ঘোড়ায় চড়ার পর অবশেষে ইভান কসচেই-এর প্রাসাদে আসলো। ভয়-ডরহীন ইভান সোজা প্রাসাদের ভিতরে ঢুকেই রানী মারিয়াকে দেখতে পেলো। কসচেই তখন শিকারের জন্য বাইরে গেছে। ইভান মারিয়াকে নিয়ে ঘোড়ায় করে দ্রুত সরে যেতে লাগলো। কিন্তু কসচেই প্রাসাদে ফিরে তার এক ঘোড়ার কাছ হতে মারিয়ার চলে যাওয়ার কথা শুনে দ্রুত এক জাদুকরী ঘোড়ার সাহায্যে এক নিমিষেই ইভান আর মারিয়াকে ধরে ফেলে। সে ইভানকে বললো, “তুমি আমার উপর দয়া দেখিয়েছিলে, তাই তোমাকে হত্যা করলাম না।”

চিত্র ৫ : ইভান মারিয়াকে নিয়ে ঘোড়ায় করে দ্রুত সরে যেতে লাগলো

পরাজিত, বিধ্বস্ত ইভান দ্বিতীয় দিনও আবার প্রাসাদে গিয়ে মারিয়াকে নিয়ে ঘোড়ায় করে দ্রুত সরে যেতে লাগলো। কিন্তু কসচেই প্রাসাদে ফিরে তার এক ঘোড়ার কাছ হতে মারিয়ার চলে যাওয়ার কথা শুনে দ্রুত এক জাদুকরী ঘোড়ার সাহায্যে এক নিমিষেই ইভান আর মারিয়াকে ধরে ফেলে। সে ইভানকে বললো, “আবার যদি তুমি একই কাজ করো, তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করবো।” কিন্তু পরাজিত, বিধ্বস্ত ইভান মারিয়াকে কোনোমতেই ভুলতে না পেরে তৃতীয় দিনও আবার প্রাসাদে গিয়ে মারিয়াকে নিয়ে ঘোড়ায় করে দ্রুত সরে যেতে চাইলো। কিন্তু এবার মারিয়া যেতে চাইলো না। সে বললো, “কসচেই এবার তোমাকে ধরলে মেরে ফেলবে।” “তোমাকে ছাড়া বাঁচার চাইতে সেটাও অনেক ভালো,” ইভানের এই উত্তর শুনে মারিয়া আর ‘না’ করতে পারলো না, ইভান মারিয়াকে নিয়ে ঘোড়ায় করে দ্রুত সরে যেতে লাগলো। কিন্তু কসচেই প্রাসাদে ফিরে আগের দুইবারের মতোই তার এক ঘোড়ার কাছ হতে মারিয়ার চলে যাওয়ার কথা শুনে দ্রুত এক জাদুকরী ঘোড়ার সাহায্যে এক নিমিষেই ইভান আর মারিয়াকে ধরে ফেললো। এবার দৈত্যটি ইভানকে খুন করে টুকরো টুকরো করে এক ব্যারেলের মধ্যে ঢুকিয়ে গভীর নীল সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলো।

কসচেই যখন ইভানকে হত্যা করে তখন সিলভার চামচ, সিলভার কাঁটা চামচ আর সিলভার তামাক বাক্সের রং পরিবর্তন হয়ে কালো হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে ইভানের তিন বোনের স্বামীরা বুঝতে পারে ইভানের কোনো বড় বিপদ হয়েছে। ঈগল নীল সমুদ্রের দিকে যায়, ব্যারেলটিকে তীরে নিয়ে আসে। রাভেন মৃতের পানি নিয়ে এসে ইভানের খণ্ডিত অংশগুলোর উপর ছিটিয়ে দেয়। ফালকন এবার বাঁচার পানি নিয়ে এসে একইভাবে ছিটিয়ে দেয়। ইভান আবার জীবন ফিরে পায়। ইভান তার বোনের স্বামীদের ধন্যবাদ জানিয়ে আবার কসচেই-এর প্রাসাদের দিকে যাত্রা শুরু করে।

কসচেই যখন প্রাসাদে ছিলো না, ইভান তখন প্রাসাদে ঢুকে মারিয়াকে বললো, “তুমি কসচেই-এর কাছ হতে শুনে রাখবে, সে জাদুকরী ঘোড়াটা কোথা হতে পেয়েছে?” কসচেই যখন প্রাসাদে আসে, মারিয়া প্রেমের অভিনয় করে জানতে চাইলে, খুশি হয়ে কসচেই বলতে থাকে, “আমি এই জাদুকরী ঘোড়া পাই বাবা ইয়াগার কাছ হতে, যে আগুনের নদীর ওপাশে থাকে এবং নদীটি আমি পার হই আমার হাতের এই জাদুকরী রুমালের সাহায্যে।” রাতে কসচেই ঘুমিয়ে পড়লে মারিয়া জাদুকরী হাত রুমালটা চুরি করে ইভানকে দেয়।

চিত্র ৬ : মারিয়া কসচেই-এর সাথে প্রেমের অভিনয় করতে লাগলো

ইভান এবার বাবা ইয়াগার ঘরের দিকে যাত্রা শুরু করলো। আগুনের নদীর তীড়ে এলে ইভান জাদুকরী হাত রুমালটি দেখালে একটা ক্রিস্টাল ব্রিজ নদীর নীচ থেকে উপরে উঠে আসে, এবং ইভান সহজেই নদী পেরিয়ে যায়। বেশকিছুক্ষণ হাঁটার পর ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ইভান এক মা পাখি আর তার বাচ্চাকে দেখে, তাদেরকে মেরে খেতে চাইলো। তখন মা পাখিটি বললো, “আমাদের মেরো না, হয়তোবা আমরা তোমার উপকারে আসতে পারি।”

চিত্র ৭ : মা পাখিটি বললো, “আমাদের মেরো না, হয়তোবা আমরা তোমার উপকারে আসতে পারি”

ইভান না খেয়ে আরো সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। বেশকিছুক্ষণ হাঁটার পর ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ইভান এবার এক সিংহী আর তার শাবককে দেখে তাদেরকে মেরে খেতে চাইলো। তখন সিংহীটি বললো, “আমাদের মেরো না, হয়তোবা আমরা তোমার উপকারে আসতে পারি।” ইভান না খেয়ে আরো সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। আরো বেশকিছুক্ষণ হাঁটার পর চরমভাবে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ইভান এবার এক মৌচাকের দেখা পেয়ে মধু খেতে চাইলো। রানী মৌমাছি তখন বললো, “তুমি মধু খেওনা, হয়তোবা আমরা তোমার উপকারে আসতে পারি।” ইভান না খেয়ে আরো সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। এভাবে সে বাবা ইয়াগার ঘরের কাছে চলে আসলো।

বাবা ইয়াগা ইভানকে দেখে ভালো ভালো খাবার দিলো, আর বললো, “আমার আস্তাবলে ঘোড়াগুলোকে দেখবে, একটাও যদি হারিয়ে যায়, তোমার মাথা কাটবো আমি।” ইভান খাবার খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়লো। বাবা ইয়াগা তার ঘোড়াগুলোকে বললো, যখন সকালের খাবার খাওয়া হয়ে যাবে, তখন যেনো ঘোড়াগুলো পালিয়ে যায়।

চিত্র ৮ : বাবা ইয়াগা

ইভান সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ঘোড়াগুলোকে মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গেলো, ওমনি ঘোড়াগুলো পালিয়ে যেতে শুরু করলো। কিন্তু মা পাখি আর তার বাচ্চারা ঠোকর দিয়ে দিয়ে ঘোড়াগুলোকে ফিরিয়ে আনলো। রাতে সব ঘোড়া আস্তাবলে দেখে বাবা ইয়াগা ক্ষেপে গেলো। ঘোড়াদের কাছ হতে ঘটনা শুনে পরের দিন জঙ্গলের দিকে পালাতে বললো। পরদিন সকাল বেলা ইভান ঘুম থেকে উঠে ঘোড়াগুলোকে মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গেলো, ওমনি ঘোড়াগুলো জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করলো। কিন্তু সিংহী তার বাচ্চাদের সহ এবং আরো কিছু সিংহীর সাহায্যে হামলা করে ঘোড়াগুলোকে ফিরিয়ে আনলো। রাতে সব ঘোড়া আস্তাবলে দেখে বাবা ইয়াগা আবার ক্ষেপে গেলো। ঘোড়াদের কাছ হতে ঘটনা শুনে পরের দিন গভীর নীল সাগরের দিকে পালাতে বললো। পরদিন সকাল বেলা ইভান ঘুম থেকে উঠে ঘোড়াগুলোকে আবার মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গেলো, ওমনি ঘোড়াগুলো নীল সমুদ্রের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করলো। কিন্তু রানী মৌমাছি তার দলবলসহ হুল ফুটিয়ে ঘোড়াগুলোকে ফিরিয়ে আনলো। রানী মৌমাছি তখন ইভানের কাছে এসে বললো, “তুমি এখনই বাবা ইয়াগার ঘরে ফিরে যাও, কিন্তু বাবা ইয়াগা যেনো বুঝতে না পারে। রাত গভীর হলে আস্তাবলের সবচেয়ে কুৎসিত অল্প বয়স্ক ঘোড়াটা নিয়ে পালিয়ে যাবে।”

ইভান ঠিক তাই করলো, এবং জাদুকরী হাত রুমাল দেখিয়ে আগুনের নদীও পেরিয়ে এলো। ঠিক তখন বাবা ইয়াগা ঘটনা বুঝতে পেরে রাগে ক্ষোভে ইভানের পিছে পিছে ছুটে আসে এবং আগুনের নদী পার হতে গিয়ে নদীতে পড়ে যায়। তারপর থেকে আর কেউ কখনো বাবা ইয়াগার নাম শুনেনি।

কিন্তু এদিকে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। ইভান যখন আগুনের নদী পেরিয়ে আসলো, তখনই হঠাৎ করে ইভানের ঘোড়াটা এক শক্তিশালী স্ট্যালিয়নে পরিণত হলো। সেই স্ট্যালিয়নে চড়ে ইভান কসচেই-এর প্রাসাদে এসে মারিয়াকে নিয়ে দ্রুত তাদের রাজ্যের দিকে যাত্রা শুরু করলো। কিন্তু এবারও কসচেই তার এক ঘোড়ার কাছ থেকে খবর পেয়ে জাদুকরী ঘোড়ার সাহায্যে ইভান আর মারিয়াকে প্রায় ধরে ফেললো। তখন ইভানের ঘোড়াটা কসচেই-এর মাথায় আঘাত করে এবং সেই আঘাতেই কসচেই মারা যায়।

মারিয়া কসচেই-এর ঘোড়ায় করে নিজের রাজ্যে ফেরত আসে, পথিমধ্যে ইভানের তিন বোনের স্বামীদের প্রাসাদে কিছুদিন বেড়ায়। ইভান আর মারিয়া এরপর নিজেদের দুই রাজ্য একত্রিত করে এবং আরো অনেক বছর সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।

চিত্র ৯ : ইভান আর মারিয়া আরো অনেক বছর সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে

সেডনাঃ এক মৎস্য-কন্যার কাহিনী


অনেক, অনেকদিন আগের কথা। তখনো পৃথিবীতে এতো লোকের আনাগোনা শুরু হয় নি। কিছু কষ্টসহিষ্ণু মানুষ তখন সাইবেরিয়া, আলাস্কা, কানাডা, গ্রীনল্যান্ড এবং স্কান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর উত্তরে বসবাস করতো। তারা নিজেদেরকে ‘ইনুইট’ বলে ডাকতো, যার অর্থ ‘মানুষ’। সেই ‘মানুষ’দের ভিতর এক খুব সুন্দরী, রুপসী মেয়ে থাকতো, যাকে সবাই সেডনা বলে সম্নোধন করতো।

সেডনা থাকতো আসলে বাফিন দ্বীপে। এক সময় সেডনার বিয়ের বয়স হলো, কিন্তু সে কাউকেই বিয়ে করতে রাজী হলো না। সেডনার বাবা খুব বড়ো শিকারি ছিলো, তাই তারা সব সময় খুব আরাম-আয়েশে থাকতো। সেডনা আসলে সেই আরাম-আয়েশ ছেড়ে থাকতে চাইলো না, তাই বাবার চাপ থাকা সত্ত্বেও সে বিয়েই করলো না। সেডনার বাবা খুব ক্ষেপে গেলো, সেডনাকে বললো, “এলাকায় শিকার অনেক কমে গেছে। এভাবে চললে আর কিছুদিন পর না খেয়ে থাকতে হবে। তোমার এখন একজন শিকারিকে বিয়ে করা উচিত,যে তোমার দেখাশোনা করবে।” সেডনা রেগে গিয়ে বললো, “প্রয়োজনে এক কুকুর বিয়ে করবো, তবুও কোনো শিকারি বিয়ে করবো না।” বাবা তাই করলো, জোর করে সে তার অবাধ্য মেয়েকে এক কুকুরের সাথে বিয়ে দিয়ে একটি আলাদা ছোট দ্বীপে নির্বাসন দিলো।

কুকুর-স্বামী প্রতিদিন খাবার নিয়ে সে দ্বীপে যেতো, সেডনাকে খেতে দিতো, আবার চলে আসতো। এভাবে অনেকদিন হয়ে গেলো। সেডনার কিছু সন্তান হলো কুকুর জাতীয়, কিছু সন্তান হলো মানুষ জাতীয়। এক সময় সেডনার মনে এই জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা শুরু হলো, বাবাও তার ভুল বুঝতে পারলো। কোনো একদিন বাবা সেডনার কুকুর-স্বামীকে হত্যা করে সেডনাকে গ্রামে নিয়ে আসে।

বেশ কিছুদিন পর, এক কায়াকে করে খুব অভিজাত পোশাকে (খুব বেশী ফার যুক্ত) এক যুবক সে গ্রামে এসে ভিড়লো। যুবকটি এসে সেডনার বাবার কাছে সেডনাকে বিয়ে করার অনুমতি চাইলো। সেডনারও খুব পছন্দ হলো। যুবকটিকে সলাজ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাদের দ্বীপে কী কোনো সুন্দরী অবিবাহিত মেয়ে নেই?” “আছে, কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্যই এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি। আমি তোমাকে খুব সুখে রাখবো, সব ধরনের খাবার তুমি পাবে, খুব সুন্দর একটা বাড়িও পাবে।” বিয়েটা হতে আর খুব বেশী সময় লাগে নি। যুবকটি বিয়ে শেষে সেডনাকে নিয়ে ওদের দ্বীপের দিকে যাত্রা শুরু করলো।

অনেক, অনেক দূরে সেডনা যখন যুবকদের দ্বীপে এলো, কাউকে দেখতে পেলো না। দেখতে পেলো না কোনো বাড়িও। দ্বীপের একপ্রান্তে এক বিশাল পাখির বাসা দেখিয়ে যুবকটি বললো, “ওই যে, আমার বাড়ি!” সেডনার বিস্মিত চোখের সামনে যুবকটি তার আসল পরিচয় দিলো। সে র্যা ভেন গোষ্ঠীভুক্ত এক বিশাল পাখি, সেডনাকে বিয়ে করার জন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে কিছু সময়ের জন্য মানুষে রুপান্তরিত হয়েছিলো। সেডনা যেনো হতাশ হয়ে পড়লো। তার স্বপ্ন যেনো ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেলো। সে অবিরত কাঁদতে শুরু করলো।

সেডনার কান্নার শব্দ বাতাসে ভেসে সেডনার বাবার কাছে পৌঁছালো। মেয়ের কষ্টে সেও খুব কষ্ট পেলো। মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে পাখি-স্বামীর দ্বীপে এলো সেডনার বাবা। বাবা যখন দ্বীপে এলো, তখন পাখি-স্বামী আর্কটিকে মাছ শিকারে বের হয়েছিলো। এই সুযোগে বাবা, সেডনাকে নিয়ে কায়াকে (এক ধরনের নৌকা) করে সেডনাদের দ্বীপের দিকে রওয়ানা দিলো।

দূর থেকে পাখি-স্বামী কায়াকে করে সেডনার চলে যাওয়া দেখতে পেয়েই বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ধাওয়া শুরু করলো। এইসব বিশালকায় পাখিগুলোর ডানার ঝাপটায় সাগরে প্রচণ্ড ঝড়ের সৃষ্টি হয়। এমন ঝড়ের সৃষ্টি হয় যে, কায়াকে বাবা আর সেডনার একসাথে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।


পাখির ডানার ঝাপটায় সাগরে এক ঝড়ের সৃষ্টি হয়

সেডনার বাবা নিজেকে বাঁচানোর জন্য সেডনাকে সাগরে ছুড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু সেডনা এতো সহজে এই পৃথিবী থেকে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সেই হিম শীতল সাগরে সাতরে সে কায়াকের কিনারা ধরে ঝুলে রইলো। কায়াক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে, বাবা সেডনার একটা আঙ্গুল কেটে ফেলে। কাটা আঙ্গুলটি সাগরে পড়া মাত্রই সেখান থেকে একটি সীল মাছের সৃষ্টি হলো। বাবা আরেকটি আঙ্গুল কাটলো, সেখান থেকে তিমি, আরেকটি আঙ্গুল থেকে ওয়ালরুস, এবং আরেকটি আঙ্গুল থেকে মাছের সৃষ্টি হলো। এক সময় সেডনা সেই হিম শীতল সাগরের তলদেশে তলিয়ে গেলো। কিন্তু মারা গেলো না, পরিনত হলো সাগরে দেবীতে, যে দেবী তার শরীরের অঙ্গ থেকে সৃষ্ট সাগরের প্রাণীগুলোর অভিভাবক হিসেবে আজও বেঁচে আছে ইনুইটদের মননে।

আর্কটিক অঞ্চলের শিকারিরা তাদের শিকারের জন্য সেডনা দেবীর উপর খুবই নির্ভরশীল। যখন সাগরে কোনো শিকার পাওয়া যায় না, ইনুইটরা বুঝতে পারে কোনো কারণে সেডনার বিশাল কালো চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। সেডনার যেহেতু কোনো আঙ্গুল নেই, সে চুল আঁচরাতে পারছে না, তাই সেডনা ক্ষেপে আছে এবং কোনো শিকার দিচ্ছে না। সেই সময় ইনুইট শামান (ধর্মীয় পুরুষ) সাগরের তলদেশে সেডনার কাছে যাত্রা শুরু করে, সেডনার চুল চিরুনি দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়িয়ে দেয়। সেডনাও খুশি হয়ে শিকারিদের কাছে শিকারদের সহজলভ্য করে দেয়। এভাবেই সেডনা হয়ে গেলো ইনুইটদের প্রধান দেবী, যার উপরের অংশ মানুষের মতো এবং নিচের অংশ মাছের লেজের মতো।


কোনো কোনো ইনুইট ভার্সনে আছে, সেডনার সাথে সাগরতলে তার কুকুর-স্বামীও রয়েছে।