গ্রীক মিথলজি ৮ (জিউস, মেটিস এবং এথেনার জন্ম)

মেটিসের কথা মনে আছে? মেটিস হচ্ছেন সেই তিনি, যিনি জিউসকে বমিকারক বস্তুটি দিয়েছিলেন এবং জিউস সেই বস্তুটি ক্রোনাসকে খাইয়ে বমি করতে বাধ্য করেছিলেন, এর ফলেই জিউসের বাকী পাঁচ ভাই-বোন ক্রোনাসের উদর থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলো। প্রকৃত পক্ষে, মেটিস ছিলেন টাইটান ওসেনাস এবং টাইটানেস টেথিসের তিন হাজার সমুদ্র কন্যার মধ্যে একজন, যাদেরকে সাধারণভাবে ওসেনিড বলা হয়। মেটিসকে অবশ্য একই সাথে দ্বিতীয় যুগের টাইটান হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সেই হিসেবে মেটিস হচ্ছেন জিউসের খালাতো/মামাতো/চাচাতো/ফুফাতো বোন (প্রতিটি ক্ষেত্রেই সঠিক!)। অবশ্য মেটিসের জন্ম হয়েছিলো জিউসের অনেক আগে।

মেটিস হচ্ছেন গভীর চিন্তা এবং জ্ঞানের দেবী। তার এই জ্ঞান বা চিন্তাশীল মননটি আবার বেশী ব্যবহার হতো ধূর্ত কাজে। তাই তিনি জিউসকে বুদ্ধি দিতে পেরেছিলেন কীভাবে তার পাঁচ ভাই-বোনকে উদ্ধার করবেন, দিয়েছিলেন বমিকারক উপাদান। অথচ, জিউস এর বিনিময়ে এক অদ্ভুত ব্যবহার করলেন মেটিসের সাথে। তিনি মেটিসের প্রেমে পড়ে গেলেন! জিউসের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা!

মেটিস খুব জ্ঞানী ছিলেন, তিনি হয়তোবা বুঝতে পেরেছিলেন, জিউসের ভালোবাসার এই শুরু, শেষ আর নেই, তাই জিউসের আহবানে সাড়া দিতে চাইলেন না। কিন্তু জিউসও ছিলেন নাছোড়বান্দা। জিউসের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য মেটিস বিভিন্ন রুপ নিতে থাকলেন- কখনো কোনো পশু, আবার কখনো কোনো পাখির। ধুরন্ধর জিউসও সেই হিসেবে নিজেকে রুপান্তর করে ফেলতেন। এক সময় হতাশ হয়ে মেটিস জিউসের কাছে নিজেকে সমর্পন করেন।

এইবার আবার গায়ার ভবিষ্যত বাণীর সময় হলো। গায়া, সাথে ইউরেনাস, ভবিষ্যত বাণী করলেন, জিউস এবং মেটিসের প্রথম সন্তান একজন কন্যা হবে এবং সেই সন্তান হবে জ্ঞানে ও শক্তিতে জিউসের সমান। আর দ্বিতীয় সন্তান যদি জন্ম নেয়, তাহলে পুত্র হবে। এই পুত্র সন্তান তার বাবা জিউসের চেয়েও শক্তিশালী হবে এবং জিউসকে ক্ষমতাচ্যুত করবে।

যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবন। ক্ষমতার স্বাদ পেলে, সেটা ছাড়তে খুব কষ্ট হয়! যে কারণে ইউরেনাস হেকাটনখিরাস এবং সাইক্লোপসদের গায়ার ভিতরে বন্দী করে রেখেছিলেন, সেই একই কারণে ক্রোনাস তার সন্তানদের গলাধঃকরণ করেছিলেন, আবার সেই কারণেই জিউস এক সিদ্ধান্ত নিলেন। যে মেটিসকে পাবার জন্য এতো কষ্ট করেছিলেন, সেই মেটিসকেই বিসর্জন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে এক মূহুর্ত দেরী করলেন না! ক্ষমতায় থাকার এমনই মহিমা! জিউস ঠিক করলেন, তিনি মেটিসকে, তার বাবা ক্রোনাস যেমন তার ভাই-বোনদেরকে গিলে ফেলেছিলেন, সেইভাবেই গিলে ফেলবেন।

দূর থেকে জিউস মেটিসকে দেখলেন কী যেনো বানাচ্ছেন। কাছে গিয়ে দেখলেন মেটিস একটি হেলমেট বানাচ্ছেন এবং সুতো দিয়ে একটি সুন্দর যুদ্ধের পোশাক বুনছেন। জিউস বুঝতে পারলেন না কেনো এগুলো তৈরী করছিলেন মেটিস। জিউসকে দেখে মেটিস কাজ থামিয়ে দেন, কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেন। জিউসকে সম্ভ্রম দেখানোর জন্য, না কি ভয়ে- সেটা বোঝা গেলো না। জিউস কিন্তু নরম সুরে মেটিসের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে লাগলেন। এক সময় মেটিসের জড়তা কেটে গেলো এবং তিনিও জিউসের সাথে সহজ হতে লাগলেন।

জিউস জিজ্ঞেস করলেন, হেলমেট এবং যুদ্ধের পোশাক মেটিস কার জন্য বানাচ্ছেন। মেটিস যেনো হঠাৎ করেই লজ্জা পেলেন, একটু সময় নিয়ে স্মিত হেসে যখন বলতে যাবেন- তখনই এক ঘটনা ঘটে গেলো। উত্তরটি দিতে গিয়ে মেটিস হয়তো লজ্জায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন, জিউস এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মেটিসকে গিলে ফেললেন। মেটিসও নাই, তাহলে মেটিসের সন্তানও নাই! অতএব, জিউস এখন নিরাপদ!

কিন্তু জিউস জানতেন না, ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। মেটিস ইতোমধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন। এবং তিনি তার গর্ভের সন্তানের জন্যই হেলমেট এবং পোশাক বানাচ্ছিলেন। আর তাই মেটিসকে গিলে ফেলার পরও জিউসের উদরে মেটিসের হেলমেট এবং পোশাক বানানো বন্ধ হলো না! হেলমেট বানাতে গিয়ে যে শব্দের সৃষ্টি হতো, সেই শব্দে খুব সহসাই জিউসের মাথা ব্যাথা শুরু হলো।

Ethena

দেবী এথেনা

 

একদিন জিউস লিবিয়ার ট্রিটন নদীর তীরে বেড়াচ্ছিলেন। এই সময়ে তার এই প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হলো। তিনি ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিলেন। দেবরাজের এই গোঙ্গানি শুনতে পেলেন হার্মিস। তিনি সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন জিউসের কাছে। জিউস হার্মিসকে আদেশ দিয়েছিলেন কামার দেবতা হেফাস্টাসকে ডেকে নিয়ে আসতে। হেফাস্টাস এসে জিউসের অবস্থা বেগতিক দেখলেন। তিনি কাল বিলম্ব না করে ধারালো কুড়াল দিয়ে জিউসের মাথায় আঘাত করে খুললেন। ম্যাজিকের মতো সেখান দিয়ে মাথায় হেলমেট পরিহিত, যুদ্ধের পোশাক পরা, হাতে অস্ত্রসহ সম্পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক হয়েই বের হয়ে এলেন এক অপ্সরী। অপ্সরীই বটে! জিউসের মাথা থেকে বের হয়ে বিজয়ের তূর্য নিনাদ বাজিয়ে ঋজু ভঙ্গিতে জিউসের সামনে এসেই দাঁড়ালেন। জিউস বুঝতে পারলেন, এ হচ্ছে মেটিস এবং তার প্রথম সন্তান- এথেনা! অন্যান্য দেব-দেবীরা সম্ভ্রমের সাথে দেখতে লাগলেন এথেনাকে, এভাবে যে পূর্বে কেউ জন্মগ্রহন করেন নি! (জিউসের মাথা থেকে জন্মগ্রহনের মাধ্যমে গায়ার ভবিষ্যতবানীর প্রথম অংশটিও নষ্ট হয়, কারণ জিউস থেকে জন্ম নিয়ে জিউসের সমান জ্ঞান বা শক্তি থাকার কথা নয়!)

The dramtic birth of Athena

এথেনার নাটকীয় জন্ম (ব্রুননেন ভন কার্ল ডনডর্ফ, ১৯১১ সাল)

 

কেউ কেউ বলেন, এথেনার জন্মের সময় হেফাস্টাস নয়, টাইটান প্রমিথিউস সাহায্য করেছিলেন। সে যাই হোক, মা-ও যেহেতু ছিলেন জ্ঞানের দেবী, তাই এথেনাও হলেন জ্ঞানের দেবী। তিনি ছিলেন সাহসীদের শক্তির উৎস। গ্রীক মিথলজিতে দেবী এথেনা এক বিশাল জায়গা জুড়ে আছেন। জিউস যদিও এথেনার জন্ম চাননি, তবুও পরবর্তীতে এথেনাই পরিণত হয়েছিলেন তার খুব প্রিয় সন্তানে।

এথেনা জন্ম থেকেই মাতৃ বঞ্চিত একমাত্র অলিম্পিয়ান, মায়ের স্নেহ কখনো পান নি। তাই তার মধ্যে পুরুষালী স্বভাবটা ছিলো একটু বেশি, সাহায্যও করতেন পুরুষদের বেশি। অরেস্টেস যখন তার বাবা আগামেমননকে হত্যা করার জন্য প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তার মা ক্লাইটেমনেস্ট্রাকে খুন করেন, এথেনা যেনো অরেস্টেসের অপরাধকে ক্লাইটেমনেস্ট্রার চেয়ে কমই গণ্য করেছেন। তিনি নিজেই বলেন,

“কোনো মা-ই আমাকে জন্ম দেন নি; এবং শুধুমাত্র বিয়ের কারণ ছাড়া আমি পুরোপুরি একজন পুরুষ এবং সম্পূর্ণভাবেই থাকি বাবার পক্ষে। আর সেইজন্যই আমি এমন কোনো মহিলাকে এতো বেশী সম্মান দিবো না, যে কিনা তার স্বামীকে খুন করে, যিনি হচ্ছেন তার গৃহের প্রভু!” (ইস্কাইলাস, ইউমেনিডেস)

আর এথেনা সম্পর্কে অন্য দেবতাদের ধারণা জানা যায় জিউসকে বলা যুদ্ধ দেবতা এরেসের কথায়,

 

“তুমি জন্ম দিয়েছ এমন এক চঞ্চল এবং বোকা মেয়ের যে একমাত্র অন্যায় কাজেই আনন্দিত হয়! অলিম্পাসের বাকী সমস্ত দেব-দেবী যেখানে তোমাকে মান্য করে এবং তোমার ইচ্ছাকেই তাদের কর্মে পরিণত করে, সেখানে একমাত্র সে-ই (এথেনা) তোমার কোনো কথা বা কাজকে প্রতিবন্ধকতাই মনে করেনা, সে চলে তার নিজের ইচ্ছে মতো!”
Birth of Athena
শিল্পীর তুলিতে জিউসের মাথা থেকে এথেনার জন্ম

(প্রথম সাতটি পর্বে গ্রীক মিথলজি অনুযায়ী সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে ডিওক্যালিয়নের প্লাবন পর্যন্ত ঘটনাপঞ্জী ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছিলো। গ্রীক মিথলজির এই লেখাকে আমি কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছি। সৃষ্টিতত্ত্ব ছিলো প্রথম ভাগ। দ্বিতীয় ভাগে থাকবে বিভিন্ন দেবতাদের গল্প- যা অষ্টম পর্ব থেকেই শুরু হচ্ছে। তৃতীয় ভাগে থাকবে বিভিন্ন ডেমিগডদের গল্প, চতুর্থ ভাগে বিভিন্ন বীর এবং অভিযানের কাহিনীসমূহ এবং পঞ্চম ভাগে থাকবে ট্রয়ের যুদ্ধ থেকে রোম নগরীর প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত। এই কাজে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমার জন্য এই সিরিজটা ধৈর্য সহকারে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া আর পাঠকদের জন্য হচ্ছে শেষ পর্যন্ত আগ্রহ ধরে রাখা। দেখা যাক, এই রাস্তার কোথায় শেষ হবে এবং শেষে কি আছে!)

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s