বঙ্গবন্ধু, আমার বঙ্গবন্ধু

সময়টা ১৯৯৬ সাল। আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ একুশ বছর পর আবার দেশ শাসনের জন্য শপথ গ্রহন করেছে। শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান শেষেই বিটিভিতে দেখানো হলো একটি গান- “শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠ, স্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রনি”, কতদিন পর বিটিভিতে বঙ্গবন্ধুর নাম!

গানটি শুনতে শুনতে আমার বাবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, পাশে থাকা আমার চোখে তখন আষাঢ় মাসের বর্ষা। বাবাকে দেখে খুব ঈর্ষান্বিত হচ্ছিলাম, কীভাবে কাঁদছে! বাবাকে দেখে খুব ঈর্ষান্বিত হচ্ছিলাম, বঙ্গবন্ধু নামক মানুষটার সাথে তাঁর থাকা স্মৃতির কারণে। বাবাকে দেখে খুব ঈর্ষান্বিত হচ্ছিলাম, কতোটা আবেগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন দেখে।

আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি, কিন্তু তাঁর কথা শুনেছি, পড়েছি। আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি, কিন্তু সমস্ত বাংলায় তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করেছি। আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি, কিন্তু বাংলাকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নকে উপলদ্ধি করতে পেরেছি। কীভাবে তাঁকে ভালোবেসে না থাকা যায়!

ঈদের দিন আমারই এক কাজিনের সাথে কথা হচ্ছিলো, সে হঠাৎ করেই বলে উঠলো- “মুজিব কীভাবে জাতির জনক? মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান কি?” আমি এতোটাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম, কিছুই বলতে পারি নি! এই ব্যর্থতা আমাদের না, এই ব্যর্থতা আমাদের পূর্বসুরীদের। তারাই ইতিহাসকে সময় মতো স্বার্থপরের মতো বিকৃত করেছে, আমাদেরকে জানতে দেয়নি প্রকৃত সত্য। আর আমরাও এতোটা আলসে হয়ে গেছি যে, ইতিহাসটাও খুলে দেখতে চাই না, অন্যের শোনা কথায় ইতিহাস মানি! এই ব্যর্থতা আওয়ামী লীগেরও। যে মানুষটার হওয়া উচিত ছিলো সবার, তাঁকে আওয়ামী লীগই বানিয়ে ফেলেছে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু।

আমরা নতুন প্রজন্ম একাত্তর দেখিনি, আমরা নতুন প্রজন্ম পচাত্তর দেখিনি। তাই যারা গোয়েবলসীয় প্রচার চালায়, তারা যখন আমাদেরকে বলে- “তোমরাতো দেখো নি মুজিব কী দস্যুগিরিই না করেছিলো,” আমরা তখন তাকিয়ে থাকি সেইসব মানুষদের দিকে, যারা সেই সময়ে ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, তাদের মধ্যে কিছু মানুষও হীন রাজনৈতিক স্বার্থে তখন সত্য প্রকাশে এগিয়ে আসেন না। মনে হয়, তাদের টুটি চেপে ধরি।

ভুল ত্রুটি নিয়েই মানুষ। কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে যেভাবে সবার সহযোগিতা পাওয়ার কথা ছিলো, সেভাবে উনি পাননি। এরপরো তিন বছরের মধ্যে তিনি যা করেছেন, অন্য কোন দেশে এই রকম পরিস্থিতিতে কখনই তা হয় নি। আজ আমরা আওয়ামী লীগ, বিএনপিকে কমপক্ষে পাঁচ বছর দেশ শাসন করার সুযোগ দিই, এমনকি স্বৈরাচারী এরশাদ এবং মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী, স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসনকারী, রাজাকারকে মন্ত্রী বানানো জিয়াও দেশ শাসন করার জন্য বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বেশী সময় পেয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তী ঐ সময়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামল দিয়ে আমরা কিভাবে বঙ্গবন্ধুকে বলতে পারি- সে ভালো জননেতা, কিন্তু রাষ্ট্রনেতা নয়! আমরাতো তাঁকে সময়ই দেই নি।

আমি তাঁর শাসন আমলের ভালো দিক আর খারাপ দিকের আলোচনা করতে আসিনি, আজ তাঁকে হত্যা করা নিয়েও কিছু বলতে আসিনি। আজ তাঁর সাথে আরো মেহেদী রাঙ্গানো গৃহবধুদের হত্যাকান্ড নিয়েও কিছু বলতে আসিনি, বলতে আসিনি দশ বছরের অবুঝ রাসেল আর সুকান্ত বাবুর হত্যা নিয়েও। আজ আমি বলতে আসিনি বঙ্গমাতার হত্যা নিয়েও, এমনকি বলতে আসিনি দায়িত্ব পালন করতে আসা সামরিক অফিসারকে হত্যার কথাও। আমি শুধু বলতে এসেছি, “বঙ্গবন্ধু এক অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন,” শুধু বলতে এসেছি-

“আজ পনেরো আগস্ট, আজ বাঙালীর শোক।
অনার্য পতাকা হয়ে বাংলার আকাশটা আজ নত হোক।
আজ খাঁ খাঁ, আজ ধু-ধু, ছিন্ন ভিন্ন মানুষ অশোক রাঢ়ে বঙ্গে হরিকেলে সমতটে
বাঙালীর বজ্রবুকে আজ ঘোর বারিপাত হোক”। 

– (“পনোরই আগষ্ট”, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা)

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s