অণুগল্পঃ একটি ভালোবাসার মৃত্যু

সন্ধ্যার গোধূলী আলোয় রায়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। চোখে আগামী দিনের রঙ্গিন স্বপ্ন। টিটু শহরের সবচেয়ে বড় এবং নামকরা হাসপাতালের আইসিইউ-এর ইনচার্জ হিসেবে গত সপ্তাহে যোগদান করেছে। দুই বছর হলো টিটুর সাথে ওর বিয়ে হয়েছে, রায়া নিজেও একজন ডাক্তার। একটি বেসরকারী হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করছে। দুইজনের ভালোবাসার বিয়ে। বিয়ের পর থেকেই রায়া চেয়েছিলো আলাদা বাসা নিয়ে টিটুর সাথে থাকতে। বাবা-মা অন্তপ্রাণ টিটু তার শিকড়কে ছেড়ে যেতে চায় নি, কিন্তু বার বার রায়ার প্ররোচনায় শেষে রাজী হলো, রায়াকে জানালো শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালের আইসিইউ-এর ইনচার্জ হিসেবে আবেদন করেছে। চাকরীটা পেয়ে গেলেই আলাদা বাসা নিয়ে দুজনে সংসার শুরু করবে। সন্ধ্যার গোধূলী আলোয় রায়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আগামী দিনের সেই রঙ্গিন স্বপ্নের কথা কল্পনা করছে।

রহমান সাহেব একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ের বিভিন্ন অলি-গলি তার জানা। কিন্তু যখন তার সমস্ত মুলধন হঠাৎ করে শিপিং ব্যবসায় খাটায়, তার অব্যবসায়ী ডাক্তার ছেলে টিটু তা মেনে নিতে পারে নি, কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তকেও অসম্মান করে নি। রহমান সাহেবের জাহাজ যখন প্রথমবারের মতো বিদেশ থেকে বিভিন্ন কোম্পানির মালামাল নিয়ে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো, তখনই টিটু তাকে আলাদাভাবে থাকার কথা জানালো। মনে মনে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলেও রহমান সাহেব তা হাসিমুখে মেনে নিলেন, শুধু জানালেন জাহাজের প্রথম শিপমেন্টটা দেশে আসার পরেই যেনো টিটু রায়াকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠে।

সময়টা ছিল কাল বৈশাখীর। রহমান সাহেব খবর পেয়েছেন আর দুই দিনের মধ্যেই জাহাজ বন্দরে এসে ভিড়বে। এদিকে আবহাওয়া অফিস থেকে সাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টির কথা প্রচার করা হলো। রহমান সাহেব খুব চিন্তিত হয়ে পরলেন। টিটুর সাথেও কথা বলতে পারছেন না, হঠাৎ করে সৃষ্ট ডাক্তার সংকটে আগামী দুইদিন টিটু হাসপাতালেই থাকবে। দুইদিন পর জাহাজ মোহনাতে এসে পৌঁছালো। একই সাথে আবহাওয়াও পাল্লা দিয়ে খারাপ হতে লাগলো। এক সময় শুরু হলো এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়।
************************
সারারাত হাসপাতালে টিটুর আতঙ্কে কেটেছে। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দে আর জলোচ্ছ্বাসের প্রবল আওয়াজে ভীতগ্রস্ত, নিদ্রাহীন টিটু সকালের দিকে যখন একটু দুই চোখের পাতা এক করবে, তখনই এক ফোনে ওর পৃথিবীটা যেনো দুলে উঠলো।

রহমান সাহেবকে যখন অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের আইসিইউতে আনা হলো, টিটু কেমন যেনো হত- বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সহকর্মীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে যখন রহমান সাহেবকে সিপিআর দিতে লাগলো, দুই চোখেই ঝাপসা দেখতে পাচ্ছিলো। টিটু দুই হাত দিয়ে সিপিআর দিয়ে যাচ্ছে, আর মানসপটে ছোটবেলা থেকে একের পর এক ঘটনা যেনো দেখতে পাচ্ছে। বুঝতে পারার পর টিটুর যখন প্রথম জ্বর হলো, ওর বাবা সারারাত বিছানার পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিয়েছিলো। টিটুর সাথে ওর মায়ের চেয়ে ওর বাবার সাথেই সম্পর্কটা ছিলো একই সাথে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং নীতিবান অভিভাবকের মতো। রায়াকে যখন বিয়ে করতে চাইলো, ওর মা মোটেও রাজী না থাকলেও, বাবার জন্যই রায়া এই বাড়িতে আসতে পেরেছিলো। আবার আলাদা বাসা নেওয়ার কথাও টিটু ওর বাবাকেই বলতে পেরেছে, মাকে নয়। সেই বাবা আজ অচেতন, টিটু নিজের বাবাকে বাঁচানোর জন্য সিপিআর দিয়ে যাচ্ছে!

ঝড়ের পরদিন সকাল বেলায় যখন খবর আসে রহমান সাহেবের জাহাজটা মোহনাতেই ডুবে গেছে, তিনি এই আঘাতটা আর সহ্য করতে পারেন নি। তাকে যখন অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়, তার কোনো কোনো আত্মীয়-স্বজন কোথায় কবর হবে সেটা নিয়ে গবেষনা শুরু করে দিলো। কিন্তু টিটুর জ্ঞান, অদম্য ইচ্ছাশক্তি সেই গবেষণাকে বেশিদূর এগোতে দেয় নি। কিন্তু রহমান সাহেবের জীবন বাতি নিভে না গেলেও, মাথায় রক্তক্ষরণের জন্য কোমা অবস্থায় সে রয়ে গেলো। টিটুর আর আলাদা বাসায় উঠে রায়ার সাথে সংসার শুরু করা হয়ে উঠলো না।
**************************
“এভাবে আর কতোদিন? কতোদিন তুমি এখানে থাকবে?” রায়া প্রায় উত্তেজিতভাবে টিটুকে জিজ্ঞেস করে। টিটু রায়ার চোখে চোখ রেখে শান্তভাবে বলে, “যতদিন না পর্যন্ত বাবা জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে,” রায়া অধৈর্য্য হয়ে উঠে, “প্রায় এক বছর হতে চললো, আর কবে জ্ঞান ফিরবে? আর তাছাড়া তুমি তো একজন নার্স রাখতে পারো। আমরা অন্য বাসায় উঠলে সেখান থেকে তুমি এক-দুইদিন পর পর দেখে যেতে পারো, তাই না?” “বাবাকে এই অবস্থায় রেখে আমি কখনো আলাদাভাবে থাকতে পারবো না, আর মা-ই বা কীভাবে সবদিক একা সামলাবে? জাহাজের ইনস্যুরেন্সের ব্যাপার আছে, কোম্পানিগুলোর ক্ষতিপূরণের ব্যাপার আছে, বাবার চিকিৎসার ব্যাপার আছে, আরো কত কি। তুমি কীভাবে এইসব কথা এখন বলতে পারলে!” অবাক হয়ে যায় টিটু, “তুমিও তো একজন ডাক্তার। আজ যদি তোমার বাবার এই অবস্থা হতো, তুমি কি করতে?”

ঝাঁঝের সাথে রায়া বলে ফেললো, “তাহলে আমার মা বলতো, জামাইকে নিয়ে অন্য জায়গায় থাকো। মাঝে মাঝে দেখে যায়ো,” অসহিষ্ণুতার সাথে আরো বলে, “আমার আর এই পরিবেশে থাকতে ভালো লাগছে না, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তুমি বুঝতে পারছো না, একজন অজ্ঞান রোগীর সাথে থাকাটা কতটা যন্ত্রণাকর ব্যাপার!” টিটু চুপ হয়ে যায়। নিনির্মেষে তাকিয়ে থাকে রায়ার দিকে, যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো সে। কি যেনো চিন্তা করে। একসময় মাথা নিচু করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। যাবার আগে অস্ফুট স্বরে বলে, “যন্ত্রণাকর ব্যাপার হলে তুমি তোমার বাবার বাসায় চলে যেতে পারো।”
*****************************
প্রায় ছয় মাস পর। টিটু হাসপাতাল থেকে বাসায় এসে এখনো রহমান সাহেবের রুমে যায় নি। ওর মা ওর হাতে একটা বন্ধ লম্বাটে খাম ধরিয়ে দিলো। চিন্তা করতে করতে খামটা ছিড়ে ভিতরের কাগজটা পড়তে লাগলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাগজটা টেবিলের উপর রেখে ওর রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। টিটুর মা কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো এটা তালাকনামা, রায়ার উকিল পাঠিয়েছে!
******************************
আজ রহমান সাহেবের রুমে ঢুকেই টিটু থমকে দাঁড়ালো। রহমান সাহেব আজ প্রায় দেড় বছর পরে চোখ খুলে তাকালেন, ডান হাতটা সামান্য উঁচু করতে পারলেন। টিটু কাছে এসে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রু, আনন্দাশ্রু।

5 thoughts on “অণুগল্পঃ একটি ভালোবাসার মৃত্যু

  1. সুন্দর ……………সাবলীল………………

    বাছা… এই স্টাইলটা একটু মডিফাই কর………এতো স্ট্রেইট বললে এটা সাহিত্য হয় না ……কথন হয়……

    তোমারে কইছিলাম একটু পশ্চিম বাংলার লেখাগুলা পড়…

    (I can’t write but can always recommend for the betterment…..)

Leave a comment