একটি অন্যরকম অণুগল্পঃ নীলা আর আমি

আজ সকাল থেকেই আকাশটা মুখ ভার করে গুড় গুড় শব্দে ডাকছে। নীলা ভেবেছে এই বুঝি বৃষ্টি নামলো, তাই ভার্সিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস থাকা সত্ত্বেও সে গেলো না। বরং বাদলা দিনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানাতে শুয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনার আয়োজন করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত যখন দুপুর হয়ে এলো, কিন্তু বারি পাত আর হলো না, নীলা খুব বিরক্ত হয়ে উঠলো। বিরক্তভাব কাটানোর জন্যই ঠিক করলো এখন এই আবহাওয়ার মধ্যে নাফিসার বাসায় যাবে। দুই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী জমিয়ে আড্ডা দিবে।

নাফিসাকে ফোন দিয়ে দুপুরে কোনো রকমে কিছু মুখে দিয়েই নীলা বাসা থেকে বের হয়ে এলো। সামনের মোড় থেকে মিটারের ভাড়ার চাইতে দ্বিগুন টাকায় সিএনজিতে করে যখন প্রধান সড়কের পাশে নাফিসার বাসার সামনে আসলো, তখনই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো।

প্রায় ভিজা অবস্থায় নীলা নাফিসার বাসায় ঢুকেই আমাকে দেখে মনে হলো ভুত দেখার মতো চমকে উঠেছে। আমি নিয়াজ, নাফিসার খালাতো ভাই। আমি আর নাফিসা ছয় মাসের বড়ো-ছোটো, তুই-তোকারি সম্পর্ক। নাফিসা আর নীলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাতে পড়ছে আর আমি নামের আগে ডাক্তার শব্দ বসানোর জন্য প্রানান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছি, থাকি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে। নাফিসার সাথে নীলার বন্ধুত্ব সেই স্কুল থেকে । ওরা দুইজনেই একই স্কুল, এরপর একই কলেজ এবং এখন একই ভার্সিটিতে একই সাবজেক্টে পড়ছে। বন্ধু বলে একেই!

নাফিসার খালাতো ভাই হবার সুবাদে নীলার সাথে আমারো সেই আদিকাল থেকেই পরিচয়। নাফিসার অগোচরে নীলার সাথে সেই পরিচয় থেকে পরিণয় কখন যে শুরু হয়েছে, তা আমি নিজেও ভুলে গেছি। নীলা জানে না, আমার সাথে ওর সম্পর্কের কথাটা আমি যে নাফিসাকে বলেছি। ও চায় নি নাফিসা আমাদের সম্পর্কের কথাটা জানুক। মেয়েরা পারেও বটে! খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে না জানিয়ে তার খালাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করা!

গত দুই দিন ধরে নীলার সাথে আমার ঝগড়া চলছে, সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে। গত দুইদিন আগে ওর সাথে দেখা করতে আমি একটু দেরি করেছি। কেনো আমি দেরি করেছি, এটাই আমার অপরাধ। তাই, নীলা এই দুইদিন আমার ফোন রিসিভ করছে না, সেও ফোন করছে না। আমি নাফিসাকে বলে রেখেছিলাম নীলা ওদের বাসায় যখনই আসবে, আমাকে যেনো খবর দেয়। নাফিসা একটু আগে আমাকে খবর দিয়েছিলো।

আমি যখন নাফিসার বাসায় এলাম, তখনই আমার ছোট বোনের বর আমাকে ফোন দিলেন, “ভাইয়া, ডাক্তার বলছে রিদিতার সিজার করতে হবে এখন। আপনার সময় থাকলে কি আপনি একটু আসতে পারবেন?” আমি এখনও ডাক্তার না হলেও, পরিবারের একমাত্র মেডিকেল পড়ুয়া ছেলে হিসেবে যে কোনো হাসপাতাল সংক্রান্ত কাজে আমার ডাক পড়বেই। আমার বোন রিদিতার সিজারের তারিখ যে আজকেই পরবে, কে যে ভেবেছিলো! এদিকে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি বিষণ্ণমনে নাফিসার বাসা থেকে বের হবার সময়ই নীলা এলো। ওর চমকে যাওয়া প্রশ্নবোধক চোখের সামনে দিয়ে আমি কিছু না বলেই বাইরে চলে আসলাম। নীলা পিছন ফিরে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।

নাফিসার রুমে ঢুকেই বললো, “কি রে, তোর পাজী, হতচ্ছাড়া ভাইকে দেখলাম মনে হলো!” কোনো রকমে না হেসে নাফিসা গম্ভীরভাবে বললো, “হ্যাঁ, আমার কাছে এসেছিলো একটা পরামর্শের জন্য। ওর মেডিকেলের জুনিয়র একটা মেয়ে গতকালকে ওকে ভালোবাসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ও হ্যাঁ বলবে, না কী, না বলবে, সে ব্যাপারে আমার মূল্যবান মতামত নিতে এসেছিলো।” নীলা ভুরু কুচকিয়ে কি যেনো বলতে গিয়ে থেমে গেলো। নাফিসার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, “চল, ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজি।”

দুই বান্ধবী মনের আনন্দে সেই ছোট্ট বেলার মতো বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। এক সময় নাফিসা বলে ফেললো, “জানিস, আজ নিয়াজ, মামা আর আমি খালা হতে যাচ্ছি।”
-মানে?
-মানে, আজ আর একটু পরে নিয়াজের ছোট বোন রিদিতার সিজার হবে, বুঝেছেন নীলামনি?

নীলা আজকের দিনে দ্বিতীয় বারের মতো চমকে উঠলো। ও জানতো, নিয়াজ বলেছে, রিদিতা মা হতে যাচ্ছে। সেটা যে আজকেই হবে নীলা বুঝতে পারে নি, আসলে বোঝার কথাও না। নীলার আর বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে না। নিয়াজের প্রতি গত দুইদিন ধরে জমে থাকা রাগটাও পানি হয়ে গেলো। খুব ইচ্ছে করছে নিয়াজের সাথে ফোনে কথা বলতে। কিন্তু নীলা কোনোভাবেই নাফিসার সামনে নিয়াজকে ফোন দিবে না। নাফিসাও বান্ধবীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো, “চল, রুমে যাই, আরেকটু ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে।”

নীলা ওর ভিজা পোশাক খুলে নাফিসার একটা পোশাক পরলো। নাফিসা চা বানানোর কথা বলে রান্নাঘরে যাওয়া মাত্রই নীলা নিয়াজকে ফোন দিলো।
-কি খবর নিয়াজ? রিদিতার কি অবস্থা?

ফোনে নীলার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর শুনে কেনো জানি না, আমার খুব ভালো লাগলো। আমার পরিবারের প্রতি ওর এই দরদের জন্যই ওকে আমি আরো বেশী পছন্দ করি। দুষ্টু কন্ঠে বললাম, “তুমি দুই মিনিট আগে মামী হয়েছো!” নীলা আমার কথা শুনে হেসে ফেললো। আরো কিছুক্ষণ নীলার সাথে কথা বলে এবং আগামীকালকে কোথায়, কখন দেখা করবো জেনে নিয়ে ফোন রেখে দিলাম।

আমার অসম্ভব আনন্দ লাগছে। আজ আমি মামা হয়েছি। মামা শব্দটার মধ্যেই একটা আলাদা ভাব আছে। আমি আবার নিয়মিতভাবে ব্লগিং করি। পিচ্চি বাবুর ছবি মোবাইলে তুলে নিয়েই হোস্টেলে চলে এলাম। দ্রুত ল্যাপটপ ওপেন করে নেটের কানেকশন দিয়ে ব্লগে ঢুকে লেখা শুরু করলাম আমার পিচ্চি ভাগনিকে নিয়ে। লেখা যখন প্রায় শেষ, নাফিসা আমাকে ফোন দিলো।
-হ্যলো, নিয়াজ, তুই কোথায়?

ফোনে ঠিকমতো নাফিসা কথাও বলতে পারছে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নাফিসা আর নীলা, দুই বান্ধবী, জমিয়ে আড্ডা দেবার পর একটু আগে নীলা বললো রাত হয়ে যাচ্ছে, বাসায় যাবে। নাফিসার বাসার সামনে কোনো সিএনজি না পেয়ে রাস্তা অতিক্রম করে আরেক পাশে যাবার সময় দ্রুতগতিতে আসা এক বাসের ধাক্কায় নীলা ছিটকে পড়ে। পুরো ব্যাপারটাই ঘটে নাফিসার চোখের সামনে।

ফোনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নাফিসা নিয়াজকে বলতে থাকে, “নিয়াজ, নীলা আর নেই। একটু আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে!”

পরিশিষ্টঃ

“মামা, এই জন্যই তুমি তাহলে এই জীবনে আর বিয়ে করলে না! এতো ভালবাসতে আন্টিটাকে!” ওর কথা বলার ধরনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম, বললাম,
-এই তো, তুই তাহলে বুঝতে পার লি।
-মামা, তুমি কী আমাকে এই আন্টির নামেই নীলা ডাকো?
একটু চুপ থেকে, একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, তোকে আমি ওর নামেই ডাকি, নীলা!”

3 thoughts on “একটি অন্যরকম অণুগল্পঃ নীলা আর আমি

Leave a reply to সাজেদুল ওয়াহিদ নিটোল Cancel reply